দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর, বাংলাদেশ যেন পরিত্যক্ত কোন অঞ্চল। যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে কলকারখানা সবই পড়ে ছিল ধ্বংস স্তুপের মত। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনের মহান দায়িত্ব নেন। তিনি স্বাধীনতাত্তোর বিপর্যস্থ বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপ
পুনর্গঠনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ভারতে আশ্রয় নেয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরে আনা। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৪০ লক্ষ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর পুন:সংস্কার এবং জরুরী ও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য সে সময় বহু দেশ থেকে ত্রাণ সামগ্রি আসে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল বণ্টন নিয়ে। সুষ্ঠ বণ্টন নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু সরকার রেড়ক্রস সোসাইটিকে জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত গঠন করে দায়িত্ব দেন।
প্রত্যেক গ্রামের লোক সংখ্যা ও আয়তন অনুযায়ী ৫-১০ সদস্যের ত্রাণ বণ্টন কমিটি গঠন করে। কমিঠিতে স্থানীয় আওয়ামী সদস্য, শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। প্রত্যেক ইউনিয়ন, থানা ও উপজেলা পর্যায়ে এই ত্রাণ কমিটি গঠন করে দায়িত্ব অর্পন করা হয়। স্বাধীনতার ২ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রায় ৯ লক্ষ্য বাড়ি ঘর নির্মাণ করে দেন যার মোট ব্যয় ছিল ৭২ কোটি ৭৫ লাখের মত।
আরো পড়ুন, বুদ্ধিজীবী কারা? ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পটভূমি
স্বাধীনতার ১ বছর পর বঙ্গবন্ধু সরকার পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক বীমা জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির জারিকৃত ১ নং ও ১৬ নং আদেশের মাধ্যমে অবাঙালি বা পাকিস্তানি মালিকানাধীন প্রায় ৮৫ শতাংশ শিল্প কলকারখানা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে সেগুলো সরকারের মালিকানায় ও দখলে নিয়ে নেয়। সরকারের জাতীয়করণের আওতায় ৬৪ টি বস্ত্রকল, ৬৭ টি পাটকল, এবং ১৫ টি চিনিকল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এছাড়া বিমান সংস্থা ও শিপিং সংস্থাকে রাষ্ট্রয়াত্ত খাতের অধীনে নিয়ে আসা হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর এসকল জাতীয়করণের পদক্ষেপ স্বাধীনতাপূর্ব আওয়ামী লীগের ঘোষিত ৭০ এর নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারের পুনর্গঠনের ৩য় পদক্ষেপ ছিল কৃষির সংস্কার। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে মানুষ বাঁচবে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। দেশ বাঁচাতে হলে কৃষি ও কৃষির সরঞ্জাম বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি তখন সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। তাঁর শ্লোগান ছিল, ‘‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।’’ কৃষি ও কৃষক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে কৃষি সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও মৌলিক কাঠামো নির্মাণে সরকার স্বল্প টাকায় বা বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ, বীজ, কীটনাশক, সার সরবরাহ করে।
আরো পড়ুন, মুজিববাদ কি? মুজিববাদের দর্শন
কৃষি সংস্কারের জমির বকেয়া খাজনা মওকুফ সহ সর্বনিম্ম ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা থেকে মুক্ত করেন। ধান, পাঠ, তামাক সহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের উপর ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে দেন। খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ স্থিতিশীলতা আনয়ন করার জন্য ১০০ টি খাদ্য গুদাম নির্মাণ করেন। এছাড়াও ১ লক্ষ্য বলদ ও ৫০ হাজার গাভী এবং প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষি ঋণ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারে ৪র্থ যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম। দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প কলকারখানা,ব্যাংক বীমা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮০ ভাগিই রাষ্ট্রের অধীনে নিয়ে নেয়।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য
সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালে ১ জুলাই থেকে পাঁচশালা পরিকল্পনা কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর লক্ষ্য ছিল,
- দারিদ্রতা দূরীকরণ। এই লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত এবং কার্যকর আর্থিক ও দ্রব্যমূল্য সংশ্লিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
- কৃষি ও প্রধান শিল্পের সার্বিক পুনর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
- অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ৩% থেকে ৫.৫% এ উন্নতি করা। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি মানব শক্তি ও সম্পদের সর্বোচ্চ বিকাশের জন্য স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করা।
- খাদ্য, বস্ত্র, চিনি, তেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি সহ এসবের বাজার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখো।
- বণ্টন নীতিমালা সমতা রাখা যেন দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধির হার গড় আয় বৃদ্ধির চেয়ে বেশি হয়।
- গ্রাম ও শহরের স্ব কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। এবং সরকারের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জনকল্যাণমূলক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করা।
- জনসংখ্যা হ্রাসের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক চেতনা বিকাশ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।
- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গ্রামীণ গৃহায়ণ নিরাপদ পানি সরবরাহ ইত্যাদি খাতে উন্নয়ন বরাদ্দ বৃদ্ধির সাথে সাথে দরিদ্র সাধারণ মানুষের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা।
- অর্থনৈতিক সংস্কারে বৈদেশিক যাবতীয় সাহায্যের উপর নির্ভলশীলতা কমানো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো উদ্দেশ্যে রফতানি কর্মকাণ্ডের সম্প্রসারণ ও বহুমুখি করা।
- কৃষি প্রতিষ্ঠান ও এর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা।
আরো পড়ুন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি?
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতাত্তাের দেশ পুনর্গঠনের পঞ্চম পদক্ষেপ ছিল শিক্ষা সংস্কার। শিক্ষার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সহ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার সন্নিবেশিত করেন।
সংবিধানে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে সারা দেশে একই পদ্ধতির গণমুখি ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন এবং নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল ছেলে মেয়েকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান করতে হবে। এছাড়া আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বঙ্গবন্ধু শিক্ষার সংস্কারের জন্য একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের দায়িত্ব পায় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত ই খুদা। খুদা কমিশন সারা দেশে ব্যাপক জরিপ ও পর্যালোচনার শেষে বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কারের একটি যুগান্তকারী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল পেশ করে।
আরো পড়ুন, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link