জাতিসংঘ গঠনের ইতিহাস ও কার্যাবলী

বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হল জাতিসংঘ। প্রতিষ্ঠার পর এটি সারা বিশ্বে শান্তি বিস্তারে  অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিপুঞ্জ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করা হয়। কিন্তু সেটি তার উদ্দেশ্য পালনে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। 

জাতিসংঘ গঠনের পটভূমি

এরপর শুরু হয় পৃথিবীর ইতিহাসে আরো একটি ভয়াবহ যুদ্ধ যাকে বলা হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ তম প্রেসিডেন্ট ফ্রঙ্কলিন ডি রুজবেল্ট জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাব দেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ৫ বছর বিভিন্ন আলাপ আলোচনার পর ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা পায়।

লন্ডন ঘোষণা: জাতিসংঘ গঠনের প্রথম প্রদক্ষেপ হল লন্ডন ঘোষণা। ১৯৪১ সালের ১২ জুন লন্ডনের সেন্ট জেমস প্রাসাদে মিত্র শক্তির ৯ টি দেশের জোটের এক সভায় এটি ঘোষণা করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি (জার্মানি ও ইতালির) বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং ভবিশ্যতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে কাজ করার নীতিমালা এই ঘোষণায় প্রনীত হয়। ঘোষণা পত্রটির নাম ছিল Inter Allied Declaration যা লন্ডন ঘোষণা নামে পরিচিত।



আটলান্টিক সনদ: জাতিসংঘ গঠনের ২য় পদক্ষেপ ছিল আটলান্টিক সনদ। ১৪ আগষ্ট, ১৯৪১ সালে সনদটি স্বাক্ষরিত হয় আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসমান ব্রিটিশ রণতরী Princess of wales এ। আমেরিকার পক্ষে সাক্ষর করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এবং ইংল্যান্ডের পক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি উনস্টল চার্চিল। 

ওয়াসিংটন ডিসি সম্মেলন: পহেলা জানুয়ারী, ১৯৪২ সালে আমেরিকার রাজধানী ওয়াসিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সংগটনটির নামকরণ করেন United Nation or UN। 

জাতিসংঘ গঠনের ইতিহাস ও কার্যাবলী, azhar bd academy


মস্কো সম্মেলন: সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্রে ১৯ আক্টোবর, ১৯৪৩ সালে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে আমেরিকা, বৃটেন, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, এবং চীন জাতিসংঘ গঠনের ব্যাপারে ঐক্যমত পৌষণ করে। ৩০ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে সম্মেলন শেষ হয় মস্কো ঘোষণা পত্র গ্রহণের মধ্য দিয়ে।

তেহরান সম্মেলন: ১ ডিসেম্বর ১৯৪৩ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বিগ থ্রি (রুজভেল্ট, চার্চিল ও স্টালিন) মসলিম দেশগুলোর প্রতি জাতিসংঘে যুক্ত হওয়ার মুক্ত আহ্বান জানান।

ডাম্বারটন ওকস সম্মেলন: ২১ আগষ্ট ১৯৪৪ সাল থেকে ৭ অক্টোবর  পর্যন্ত ২ দফায় আমেরিকার রাজধানীর অদূরে অবস্থিত ডাম্বারটন ওকসে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় এক গুরত্বপূর্ণ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করে ৫ টি দেশকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। দেশগুলো হল,- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, ও চীন।

ইয়াল্টা সম্মেলন: ৪-১১ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৫ সালে ইউক্রেন এর ইয়াল্টা শহরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।  এই সম্মেলন থেকে জাতিসংঘের স্থায়ী দেশগুলোকে ভেটো ক্ষমতা প্রধান করা হয়। জাতিসংঘ সনদের ২৭ নং অনুচ্ছেরদ ভেটোর বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।
 
সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন: জাতিসংঘ গঠনের চুড়ান্ত সম্মেলন হচ্ছে সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন। ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন আমেরিকার বিখ্যাত সানফ্রান্সিসকো শহরে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ৪৬ টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় এই সম্মেলন। সম্মেলন চলাকালে আরো ৪ টি দেশকে আমন্ত্রন জানানো হয়। দেশগুলো হল ডেনমার্ক, আর্জেন্টিনা, ইউক্রেন ও বেলারুশ।


সর্বমোট ৫০ টি দেশের ১১১ অনুচ্ছেদ বিশিষ্ট জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন সম্মেলনটি সমাপ্ত হয়। পোল্যান্ড তাদের জাতীয় নির্বাচনের কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে পারেনি। পরবর্তিতে ১৫ অক্টোবর ৫১ তম দেশ হিসেবে জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করে। তাই পোল্যান্ড সহ মোট ৫১ টি দেশকে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য বলা হয়।

পরিশেষে, ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হয়। তাই ২৪ অক্টোবর বিশ্ব জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।



জাতিসংঘের কার্যাবলী

জাতিসংঘের মূল সংস্থা ৬টি। সংস্থাগুলো আলাদা আলাদা কার্যক্রমে ভূমিকা রাখে। 
১. সাধারণ পরিষদ (General Assembly): জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ এই পরিষদের সদস্য হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রত্যেক বছর ১ বার এই পরিষদের অধিবেষন বসে। 


প্রত্যেক সদস্য দেশ সর্বোচ্চ ৫ জন প্রতিনিধি পাঠাতে পারবে, তবে ভোট দিতে পারবে কেবল একজনই। সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে জাতিসংঘের মহাসচিব, নিরাপত্তা পরিষদ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুরোধে। এই সংস্থার সভাপতি ১ বছরের জন্য সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হয়। 

সাধারণ পরিষদের বিভিন্ন উদ্যোগ,
  • মানবাধিকারকে সার্বজনীন ঘোষণা: ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে সাধারণ পরিষদের ৩য় সম্মেলনে মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা (Universal Declaration of human Rights) গৃহীত হয়। 
  • কোরিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ১৯৫৩ সালে সালে কোরিয়া যুদ্ধের অবসান কল্পে শান্তির জন্য প্রস্তাব বা Uniting for peace resolution গ্রহণ করে।
  • CEDAW কনভেনশন: নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ১৯৭৯ সালে CEDAW কনভেনশন গ্রহণ।
  • সমুদ্রে আইন কনভেনশন: স্বাক্ষরিত হয় ১৯৮২ সালে
  • জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক কনভেনশন ১৯৮৯
  • টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্য বা SDGs (2016-2030) গ্রহণ।
২. নিরাপত্তা পরিষদ (Security Council): জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী সংস্থা হল নিরাপত্তা পরিষদ বা স্বস্তি পরিষদ। এই পরিষদের সুপারিশক্রমে বাকি সকল সংস্থার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য দেশ ১৫ টি। এর মধ্যে স্থায়ী সদস্য দেশ ৫ টি। 

দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন এবং ফ্রান্স। এই ৫ রাষ্ট্রকে বলা হয় সুপার পাঁচ। এদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। সদস্য দেশের যে কোন একটি দেশের ভেটোর ফলে যে কোন সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী দেশ ১০ টি। প্রতিটি অস্থায়ী দেশ ২ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়।

নিরাপত্তা পরিষদকে জাতিসংঘের নির্বাহী পরিষদ বলা হয়। এই পরিষদে বিভিন্ন দেশের সমস্যা নিরোসন আলোচনা, মধ্যস্থতা, ও বিচারের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।

৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (Economic and social council): মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, বেকার সমস্যা সমাধান, শিক্ষার প্রসার, মানবাধিকার কার্যক্রম এবং বিভিন্ন কল্যানমূলক বিষয়ে সাধারণ পরিষদে সুপারিশ প্রেরণ করে থাকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। প্রতি ৩ বছরের জন্য সদস্য নির্বাচিত হয়। এই সংস্থাকে বলা হয় ‘‘জাতিসংঘ পরিবার’’ নামে।

৪. সচিবালয় (Secretariat): এটি জাতিসংঘের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। জাতিসংঘের মহাসচিব ও তাঁর অন্যন্য কর্মকর্তা নিয়ে সচিবালয় গঠিত। সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিযুক্ত হয়। একজন মহাসচিব ৫ বছরের জন্য নিযুক্ত হয়। জাতিসংঘের বর্তমান(৯ম) সভাপতি অ্যান্তোনিও গুতেরাস। 

৫. অছি পরিষদ (Trusteeship): উপনিবেশ অধীনস্ত দেশগুলোকে স্বাধীন করে তাদের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত করাই মূলত অছি পরিষদের কাজ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ৫ সদস্য দেশ এই পরিষদের সদস্য। বর্তমানে অছিভুক্ত একমাত্র অঞ্চল হলো যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকা প্যাসিফিক আইল্যান্ড। 

৬. আন্তর্জাতিক আদালত (International Court of Justice): এটি জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রনাধীন একটি আন্তর্জাতিক বিচারালয়। আন্তর্জাতিক যে কোন বিরোধের ক্ষেত্রে যে কোন সদস্য রাষ্ট্র অন্য সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিচারপ্রার্থী বা মামলা করতে পারবে। তবে এই আদালতে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেনা। আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকের সংখ্যা ১৫ জন। তারা ৯ বছরের জন্য নিযুক্ত  হয়। এর সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে। 

আরো পড়ুন, সার্ক (SAARC) কি?

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন