যে কোন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বের অন্যন্য দেশকেও প্রভাবিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর পরাশক্তি দেশগুলো যখন কোল্ড ওয়ার বা ঠান্ডা যুদ্ধে লিপ্ত ঠিক তখই সংগঠিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। স্বভাবিকভাবে পরাশক্তি দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে যে কোন পক্ষ অবলম্বন করে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলো তাদের নীতি স্পষ্ট করেছিল। প্রতিবেশি রাষ্ট্র চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন দেয়। মূলত চির শত্রু ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার ঠেকাতে চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল।
পরাশক্তির অন্যতম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে সাহার্য সহযোগিতা করে। এমনকি পাকিস্তানের পরাজয় দেখে যখন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণার আহ্বান করে তখন সোভিয়েত এর বিপক্ষে ভেটো প্রদান করে। মার্কিন প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। বহি বিশ্বে এই যুদ্ধকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরিণ সমস্যা হিসেবে দেখিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও পত্র পত্রিকা।
মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা
তবে পাকিস্তান যেহেতু মুসলিম প্রধান দেশ তাই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় মুসলিম বিশ্ব তাদেরকে সমর্থন দেয়। এমনকি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সংগঠন ওআইসি ও আরব লীগ পূর্ব পাকিস্তানে নির্যাতন, এবং গণহত্যার পরেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
মুসলিম বিশ্ব পাকিস্তান নীতি গ্রহণ করার অনকেগুলো কারণ রয়েছে। তারমধ্যে,
পাকিস্তানের দু অংশের ইসলামি সংহতি রক্ষা, এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষায় মুসলিম বিশ্ব সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যে, এটি ভারতের হিন্দুদের অপপ্রয়াস। তারা (হিন্দুরা) পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সংহতি বিনষ্ট করে আলাদা করতে চায়। পাকিস্তানের সংবাদপত্র ভারতে গমণকারী শরণার্থীদের হিন্দু হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে।
এছাড়াও মুসলিম বিশ্বে এটিকে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হিসেবেও দেখানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদেরকে ভারতীয় এজেন্ট বলে আখ্যায়িত করেছে। মুসলিম বিশ্বের কাছে এমনভাবে প্রচার করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হলে দেশটি হবে একটি কমিনিষ্ট ও ধর্মহীন রাষ্ট্র। আর ভারতের হস্তেক্ষেপের বিষয়টিকে মুসলিম বিশ্ব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি।
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক থাকার কারণে তারা পাকিস্তান নীতি গ্রহণ করে। এই নীতির পিছনে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সার্বিক সমর্থনে পাকিস্তানকে আরো বেশি আরব বিশ্বের সমর্থন এনে দেয়। ১৯৬৭ সাল থেকে সৌদি আরব সহ আরব বিশ্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং যাবতীয় অস্ত্রের যোগানদাতা হিসেবে পাকিস্তানের উপর নির্ভর হয়ে পড়ে। যার ফলে মুক্তিযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য সহ মুসলিম দেশগুলো পাকিস্তানকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়।
সত্তর এর দশকে পরাশক্তি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুসলিম বিশ্বের ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি পায়। কারণ চীন পাকিস্তানের মাধ্যমে আরব বিশ্ব, বিশেষ করে ইরান, ইয়েমেন, মিশর, এবং সিরিয়ার মত দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুনভাবে স্থাপন করে।
এসময় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সমূহ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রাখে। অধিকাংশ মুসলিম দেশে তাদের দ্রুতাবাস থাকায় মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত বিরোধী প্রচারণা চালাতে ব্যাপক সাহার্য করেছিল।
মুসলিম বিশ্বের বাংলাদেশ বিরোধিতার আরো একটি অন্যতম কারণ ছিল ইসরাইল রাষ্ট্রের বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ইসরাইলের পার্লামেন্টে পাকিস্তান সামরিক চক্রের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যাকে নিন্দা করে একটি প্রস্তাব পাশ করে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য ঔষধ, বস্ত্র ও খাবার পাঠানোর ঘোষণা দেয়। ইসরাইলের এসকল নীতি মুসলিম বিশ্বকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে। আরব বিশ্ব বুঝতে পারে যে এটি মুসলিম বিরোধী একটি চক্রান্ত। যদিও বাংলাদেশের প্রবাসি সরকার ইসরাইলের যাবতীয় সহযোগিতা সরাসরি প্রত্যাখান করে।
আরো পড়ুন, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পার্থক্য
মুসলিম বিশ্বের কাছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও গণহত্যার মত বিষয়গুলো বিশ্ব মিড়িয়ায় জোরালোভাবে প্রকাশ করেনি। এর ফলে মুসলিম বিশ্ব এ ব্যপারে তেমন কিছুই সঠিকভাবে জানতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম দেশগুলো পাকিস্তানের প্রতি নীতি গ্রহণের বিবেচনায় দেশগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম দেশ। এ তালিকায় আছে ইরান, সিরিয়া, সৌদি আরব,লিবিয়া, জর্ডান, এবং তুরস্ক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দেশগুলো মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানকে একতরফাভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছিল।
দ্বিতীয়ত, মধ্যমপন্থী মুসলিম দেশ। এ তালিকায় আছে ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, আফগানিস্তান, মিশর, ইরাক, লেবানন, এবং সুদান। এসকল দেশ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ড রক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিলেও পাকিস্তানের নির্বিচার গণহত্যাকে মেনে নেয়নি।
তৃতীয়ত, মৌন সমর্থনকারী মুসলিম দেশ। এ তালিকায় রয়েছে নাইজেরিয়া, সেনেগাল, সোমালিয়া, উত্তর ইয়েমেন, তিউনেশিয়া, মৌরিতানিয়া অন্যতম। তবে এ দেশগুলোর তখন আন্তর্জাতিক তেমন কোন প্রভাব ছিলনা বিধায় তারা এরকম পক্ষ নিতে বাধ্য হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link