রুশ বিপ্লব বিংশ শতাব্দীর অন্যতম রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ঘটনা। সহিংস বিপ্লবটি রোমানভ রাজবংশের সমাপ্তি এবং শতাব্দীর রাশিয়ান সাম্রাজ্য শাসনের অবসান করে। বিপ্লবের সময় বামপন্থী বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করেছিলেন। বলশেভিকরা পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়।
রুশ বিপ্লব
১৯১৭ সালের সংগঠিত রুশ বিপ্লবে রাশিয়ায় একাধারে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে যখন সমগ্র পৃথিবীতে এক বিরাট পরিবর্তন তখনই এই বিপ্লব ঘটে। রুশ বিপ্লব রাশিয়ার স্বৈর শাসনকে বিলুপ্ত করে।
তখন দুটি বিপ্লব রাশিয়ায় অভ্যন্তরে ঘটে। একটিতে শতাব্দীর সাম্রাজ্য শাসনের অবসান ঘটে এবং দ্বিতীয়টিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের দিকে পরিচালিত করে এমন রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন। দুটি বিপ্লবের ঘটনা কাছাকাছি কয়েক মাসের মধ্যে সংঘটিত হয়।
উনিশ শতাব্দির শেষের দিকে রাশিয়া ছিল ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশগুলোর একটি। কৃষক এবং দরিদ্র শিল্প শ্রমিক জনগোষ্ঠী ছিল বেশি।
পশ্চিমা ইউরোপের বেশিরভাগ ধনী দেশই রাশিয়াকে একটি অনুন্নত এবং পিছিয়ে পড়া দেশ হিসাবে দেখত। রাশিয়ার অভিজাতরা ভূমিদাসত্ব প্রথা চর্চা করত। সামন্তবাদের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকরা জমির মালিকদের সেবা করতে বাধ্য থাকত।
তবে ১৮৬১ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্য অবশেষে ভূমিদাসত্ব প্রথা বাতিল করেছিল। ভূমিদাসত্বের মুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করার একরকম স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে রাশিয়ান বিপ্লবকে প্রভাবিত করে।
রুশ বিপ্লবের পটভূমি
রাশিয়া পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার তুলনায় অনেক পরে শিল্পায়িত হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়ার শিল্প বিপ্লব সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
১৮৯০-১৯১০ সালের মধ্যে রাশিয়ার বিখ্যাত দুটি শহর সেন্ট পিটার্সবার্গ এবং মস্কো শহরগুলির জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে নতুন শ্রেণির রাশিয়ান শিল্প শ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড়ে তাদের জীবনযাত্রার মানের হ্রাস ঘটে।
এছাড়া জনসংখ্যার উত্থান, ব্যয়বহুল ক্রিমিয়ান যুদ্ধ (১৮৫৪-৫৬), এবং বিশাল সাম্রাজ্য জুড়ে ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকট বিপ্লবের পথ তৈরি করে। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিশাল বিক্ষোভের ফলে ১৯০৫ সালের রক্তাক্ত গণহত্যার ঘটনা ঘটে। কয়েকশ নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীর উপর জার সেনাবাহিনীর আক্রমণ চালালে অনেকে আহত ও নিহত হয়।
রুশ বিপ্লবের সংগঠিত হওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ বিদ্যামান। স্বৈরতন্ত্রের অপব্যবহার, ক্রিমিয়াম যুদ্ধে, জাপান যুদ্ধে, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শুরুতে রাশিয়ার কয়েকটি সামরিক বিপর্যয়ের ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরিন বিপ্লব দেখা দেয়। তবে ১৯০৫ সালের গণহত্যার ঘটনাটি রুশ বিপ্লবের সূচনা করেছিল।
রুশ বিপ্লবে রাশিয়ার প্রসিদ্ধ লেখকদের ভূমিকাও অপরিসীম। লিও টলস্টয়, টুর্গনিভ, ডসটয়েভস্কির মতো অসংখ্য লেখকের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লেখা সর্বত্র জার শাসকের প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করে। রাশিয়ার স্বতন্ত্র্য ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীরা পশ্চিমা বিশ্বের অনুকরণে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি তোলে।
আরো পড়ুন, স্নায়ু যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
পরপর কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে রাশিয়ার দ্রব্যমূল্যের দাম অতিরিক্ত আকারে বাড়তে থাকে। ফলে কলকারখানা ও যানবাহন বন্ধ হয়ে পড়ে। শহরাঞ্চলের এই খাদ্যাভাবের কারণে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে উঠে।
১৯১৭ সালের ৮ ই মার্চ, মহিলা শ্রমিকরা খাদ্যের দাবিতে পেট্রোগ্রাডে সূতিকলে এক ধর্মঘটের ডাক দেয়। এর পরের দিন রাশিয়ার অন্যন্য শ্রমিকরা রুটির দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের মুখে স্লোগান ছিল, ''Down with the war, Down with the autocracy'' বা যুদ্ধ নিপাত যাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাক যাক।
সারা দেশে যখন বিপ্লব বিশাল মূর্ত আকার ধারণ করে তখন জার শাসক নিকোলাস রাজনৈতিক সংস্কার স্বরুপ দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বিপ্লবিদের দাবি ছিল জার স্বৈতন্ত্রের বিলুপ্তি। অবশেষে জার নিকোলাস সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link