রাজাকার, আলবদর, আল শামস, এবং শান্তি বাহিনী

১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থি ধর্মীয় ভাবধারার কিছু সংগঠন এবং তাদের নেতা কর্মীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহার্য করে। ধর্মীয় মূল্যবোধকে ভিত্তি করে এদেশের কিছু মানুষ পাকিস্তানের নির্মম অত্যাচার, নিপীড়ন, এবং গণহত্যায় অংশীদার হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানে পথঘাট দেখানো থেকে শুরু করে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান দেওয়ার কাজ করত রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামের স্বাধীনতা বিরোধী এই সংগঠন সমূহ। 
রাজাকার, আলবদর, আল শামস, এবং শান্তি বাহিনী, azhar bd academy

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে থেকে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে অথবা লুণ্ঠন করত স্বাধীনতা বিরোধী চক্ররা।  আজকের আলোচনা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানপন্থি সহযোগি সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করব।

শান্তি কমিটি

৯ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে ১৪০ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে পূর্ব বাংলায় সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য এটি গঠিত হয়। শান্তি বাহিনীর প্রধান আহবায়ক ছিলেন পাকিস্তানের খাজা খয়ের উদ্দিন। এই বাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিল জামায়াত, মুসলিম লীগ সহ পাকিস্তানের অন্যন্য ধর্মীয় দলের প্রধান নেতারা।


শান্তি কমিটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দৈনিক পাকিস্তান ২৬ এপ্রিলে এক সংবাদে বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘পাকিস্তানের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দ্রুত পুন: প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জনগনকে সজাগ রাখা এবং গুজব রটনাকারীদের দুরভিসন্ধি প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে‘‘।

২৩ জুলাই, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিশিষ্ট সাংবাদিক পিটার লিখেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের উপর সেনাবাহিনীর আস্থার ঘাটতি থাকায় তাদের মাথার উপর দিয়ে ছড়ি ঘোরানোর জন্য ক্ষমতা দিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়।’’

শান্তি কমিটির কাজ ছিল মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করা। রাজাকার বাহিনীতে লোকবল নিয়োগে দায়িত্ব পালন। এছাড়া হিন্দু ও স্বাধীনতাপন্থি বাঙারিদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, এবং জমি দখল করে নিজেরা ভাগ করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল।

রাজাকার

১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনা জেলায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। রাজাকার শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ। জামায়াতের ৯৬ জন কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনীর সূত্রপাত হয়। ২৮ শে মে, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিনান্স জারি করে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করে এই রাজাকার বাহিনীকে।


শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ বাঙালি আনসার মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে আনসার শূন্য হয়ে যায়। এমনাবস্থায় রাজাকার বাহিনীকে আনসার বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করে একটি আইন পাশ করে পাকিস্তান সরকার।
৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে সরাসরি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অধীনে আনা হয়। সেপ্টেম্বর মাসেই রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ৫০,০০০।

রাজাকার বাহিনীর কাজ ছিল পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সহযোগি হিসেবে সমগ্র পূর্ব বাংলায় হত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠন করা। তিন চার সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে তাদেরকে অস্ত্র হিসেবে পয়েন্ট থ্রি নট থ্রি রাইফেল দেওয়া হত। পাকিস্তান বিরোধী সাধারণ জনগনন এবং মুক্তিবাহিনীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত অধিকাংশ সময় তারাই নিতো।
রাজাকার বাহিনীর নিশংস দেখে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন, ‘‘পাকিস্তান কর্তৃক পাকিস্তান হত্যা বন্ধ করতে হবে‘‘। এছাড়া রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাহারার দিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

আলবদর

২২ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর প্রথম আত্মপ্রকাশ হয়। তখনকার ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়।
জামালপুরে আলবদর বাহিনী দ্বারা ৬ জন মুক্তিবাহিনী হত্যার মাধ্যমেই তাদের নাম ছড়িয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগস্টে সমগ্র দেশের ইসলামি ছাত্র সংঘকে আলবদর বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি করা হয়।


এই বাহিনী সম্পর্কে জামায়াতপন্থি পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলে, ‘‘আলবদর একটি নাম, একটি বিস্ময়। আল বদর একটি প্রতিজ্ঞা। যেখানেই মুক্তি বাহিনী আলবদর সেখানেই। ভারতীয় দুষ্কৃতিকারীর কাছে আলবদর এক ভয়ংকর নাম।

আলবদর বাহিনী সম্পর্কে মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন তাঁর ম্যাসাকার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘‘ধর্মান্ধ ছাত্রদের নিয়ে গোপনে তৈরি করা হয় আলবদর বাহিনী। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের গোপনে হত্যার পরিকল্পনা করে। আলবদর এই সকল হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল লোকচক্ষুর আড়ালে‘‘।

বদর বাহিনীর প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তুলে এনে হত্যা করা। বিশেষ করে রায়ের বাজার ও মিরপুরে নিয়ে হত্যা করত তারা। বদর বাহিনী সাদা পোশাকে, এবং মুখে রুমাল বেঁধে অপারেশনে যেত।

আল শামস

আল শামস একটি আরবি শব্দ, এর অর্থ ‘সূর্য’। মুক্তিযুদ্ধের সময় নেজাম-ই- ইসলামি ছাত্র সংগঠনের সদস্যসহ অন্যন্য ধর্মীয় দলের সদস্যদের নিয়ে আল শামস বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আল শামস বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে কাজ করতো। বিশেষ করে এদের টার্গেট থাকতো বাঙ্গালী লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, প্রগতিশীল অধ্যাপক ইত্যাদি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ধরা ও হত্যা করার ব্যাপারে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করত।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দ্বারা গঠিত নিন্দিত আধা সামরিক মিলিশিয়া বাহিনী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনীকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে (বর্তমান বাংলাদেশ) আল শামস বাহিনী গঠন করা হয়।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন