বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থে স্বাধীনতার পক্ষে অথবা বিপক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এমন সময়ে হয়েছিল যখন বিশ্বের দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এবং আমেরিকার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। এই ঠান্ড যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একদম প্রথম থেকেই সোভিয়েত সমর্থন পেয়ে আসছিল। বিপরীতে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দেয়। যদিও আমেরিকার জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল।

বাংলাদেশের প্রতিবেশি দেশসমূহের ভূমিকাও ছিল স্বার্থন্বেষী। ভারত সরকার এবং তার জনগণ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সাহার্য সহযোগিতা করে। কারণ ঐতিহাসিকভাবে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব ছিল বহু বছরের। এছাড়া ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি ও পরবর্তীতে কাষ্মীর প্রশ্নে পাক-ভারত যুদ্ধ মূলত বাংলাদেশের যুদ্ধে ভারতের সমর্থনে ভূমিকা পালন করে। 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা, azhar bd academy


প্রতিবেশি দেশ চীনের ভূমিকা ছিল সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে। চীনের সাথে ভারতের সীমানা কেন্দ্রীক দ্বন্দ্ব সব সময় লেগেই থাকে। চীনের ভারত বিদ্ধেষ থাকার কারণে শুরু থেকেই চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। 
মুক্তযুদ্ধে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, যুদ্ধটি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম বিশ্ব কখনই চাইবেনা পাকিস্তানের মসলিমরা বিভক্ত হয়ে পডুক। তৃতীয়ত, ইসরাইল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়া। চতুর্থত, ভারতের চক্রান্তে পাকিস্তানকে দুই অংশে আলাদা করা। এছাড়াও রয়েছে মুসলিম বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য না পৌছানো।

আজকের আলোচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিকা

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকা ছিল মূলত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। ফলে মার্কিন প্রশাসন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করে। তবে মার্কিন প্রশাসন এবং তাদের দেশের জনগণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তাদের দেশের গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, সরকারী কতিপয় কর্মকর্তা, এবং বিশেষ করে আমেরিকার সাধারণ জনগণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে।

বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি করতে আমেরিকার পত্র পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, নিউজউইক ম্যাগাজিন,ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, এবং বাল্টিমোর সান ইত্যাদি পত্রিকা অন্যতম। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মার্কিন নীতি ছিল মূলত নিরপেক্ষতা। তারা এটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং মার্কিন প্রশাসনের এমন মন্তব্যের বিরুদ্ধে বলেন, ‘‘পূরব পাকিস্তানের ঘটনা কোন অভ্যন্তরীন ঘটনা হতে পারে না। এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতে পারে না।

ফলে প্রবল চাপে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ ও যাবতীয় সহযোগিতা স্থগিত রাখে। কিন্তু গোপনে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে সামরিক সাহার্য অব্যাহত রাখে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। হেনরী কিসিঞ্জার কূটনৈতিক কারণে চীন ভ্রমণ করে চীনের সমর্থন লাভ করে এবং চীনের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়। এটা করার একমাত্র কারণ ছিল সোভিয়েত আধিপত্য কমানো। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান নীতি সক্রিয় লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে যখন ভারত বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী গঠিত হয় তখন মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের আহবান করে।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রশাসন প্রতিশ্রুত ভারতের জন্য ৮৬.৬ মিলিয়ন ডলার সাহার্য বন্ধ করে দেয় এবং জাতিসংগের মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখে। তবে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা বাংলাদেশকে প্রথম থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং ফ্রেড হ্যারিস পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। তারা পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধে এবং দু:স্থদের সাহায্যের দাবি জানায়।

মার্কিন সাংস্কৃতিক শিল্পীরা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়। মুজিব নগর সরকারকে সহযোগিতা এবং ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি শরণার্থীকে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ১ আগস্ট নিউইয়র্কে একটি কনসার্টের আয়োজন করে। এতে শিল্পী হিসেবে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, লিয়ন রাসেল, পন্ডিত রবি সংকর প্রমুখ। কনসার্টের নাম দেওয়া হয় Concert for Bangladesh

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন সাংবাদিক কর্মীদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মত। তাদের সংবাদের ভিত্তিতেই সারা বিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানের নৃশংশ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে জানতে পারে। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিদেশী সাংবাদিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদকর্মী সিডনি এইচ. শনবার্গ গোপনে ভারতের মুম্বায়ে আশ্রয় নিয়ে ২৮ মার্চ ঢাকার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২৮ মার্চ তিনি ঢাকার জনগণ ট্যাংকারের বিরুদ্ধে লাঠি দিয়ে লড়াই করছে শিরোনামে আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এছাড়া ৩০ মার্চ নিউইয়র্ক পোস্ট, ৫ এপ্রিল নিউজউইক পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) শুরু থেকেই বিরাট ভূমিকা পালন করে। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা এবং নির্মম অতঅচারের নিন্দা জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও স্নায়ু যুদ্ধের কারণে প্রতিপক্ষ আমেরিকার বিরুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্নে তারা বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। এছাড়া এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য বিস্তাররোধ করতে সোভিয়েত সংকল্পবদ্ধ ছিল। ৯ আগস্ট সোভিয়েত এবং ভারত মৈত্রী জোট গঠন করে প্রতিপক্ষ চীন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে, যদি তারা (আমেরিকা ও চীন) যুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয় দেখে নিক্সন মার্কিন ইউএসএস এন্টারপ্রাইজকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করেন। এর জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিউক্লিয়ার মিশাইলবাহী দুটি ডুবো জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করে। এর পূর্বে ৪ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জাবি তোলেন। নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অনতিবিলম্বে যুদ্ধ স্থগিত, ভারত পাকিস্তানের সৈন্য নিজ দেশে ফিরিয়ে যেতে জাতিসংঘ মহাসচিবকে এক প্রস্তাব দেন। কিন্তু এই প্রস্তাব একতরফা বলে সোভিয়েত এতে ভেটো প্রদান করে।

চীন ও মার্কিন যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নে সোভিয়েত ভেটোর বিষয়ে কারণ ছিল মূলত বাংলাদেশ সংকটের একটি স্থায়ী সমাধানের। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা দখল করার পর সোভিয়েত আর যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নে ভেটো দেয়নি। ফলে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পনের পর ২১ ডিসেম্বর যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব গৃহীত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশপন্থী নীতি গ্রহনের প্রধান কারণ হচ্ছে চীনের প্রভাব হ্রাস এবং প্রতিদ্বন্দ্বী একমাত্র রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কূটনৈতিক বিজয় লাভ করা।

coming...

চীনের ভূমিকা
ভারতের ভূমিকা
মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা


Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন