গণহত্যা কি? গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে করণীয়

মানব সভ্যতার ইতিহাসে গণহত্যা একটি নিকৃষ্টতম অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। গণহত্যা বা জেনোসাইড শব্দটি গ্রিক জেনোস এবং ল্যাটিন সাইড থেকে আগত। শব্দ দুটির অর্থ জাতি হত্যা বা শ্রেণী হত্যা।

গণহত্যা কি?

জেনোসাইড বা গণহত্যা শব্দটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ব্যবহার করেন পোল্যান্ডের বিতাড়িত ইহুদি আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন। তাঁর মতে গণহত্যা হচ্ছে, বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যা, আক্রমণ, এবং পীড়ন ইত্যাদি। 

গণহত্যা কি? গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে করণীয়, azhar bd academy

আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা বলতে, কোন সরকার কর্তৃক পরিচালিত ইচ্ছাকৃতভাবে কোন জাতিগত, ধর্মীয়গত, এবং গোত্রীয় দলভুক্ত জনগণের বিনাশ সাধন। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ একটি কনভেনশনের মাধ্যমে গণহত্যার বিচারের জন্য শাস্তির বিধান করে। ফলে নিম্মের অপরাধগুলো গণহত্যার পর্যায়ে পড়বে,

  1. কোন জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা
  2. কোন নির্দিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন
  3. কোন গোষ্ঠীর দৈহিক অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বা আংশিক নষ্ট করা
  4. কোন জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে মানবজন্ম প্রতিরোধ এর ব্যবস্থা করা
  5. এক গোষ্ঠীর শিশুদের জোরপূর্বক অন্য গোষ্ঠীতে প্রেরণ করা

বাংলাদেশের গণহত্যা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশব্যাপী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশীয় সহযোগীদের নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সরকারি হিসাবে অনুযায়ী প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি সাধারণ মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র, এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এর মধ্য রাতে কয়েক ঘণ্টার হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে ভয়াবহ চিহ্নিত করে সেটিকে কালরাত্রি বলে অভিহিত করা হয়। 

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘‘অপারেশন সার্চ লাইট’’ নামে পরিচালিত অভিযানে হাজার হাজার বাঙালিকে কয়েক ঘণ্টায় হত্যা করা হয়েছিল। সেই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালিদের ওপর বন্দুক ও কামান নিয়ে হামলা চালায়।


২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর “আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস”পালনের ঘোষণা করা হয়। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয় বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশের সদস্যরা। ফলে ২৫ শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সুযোগ নেই। 

তবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি পেতে সহায়ক হবে। পদক্ষেপ গুলো হলো,

বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে করণীয়

বাংলাদেশের গণহত্যা স্বীকৃতি পেতে সহায়ক পদক্ষেপ সমূহ নিম্মে আলোচনা করা হল।

ক. কূটনৈতিক পদক্ষেপ
এর জন্য কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পাকিস্তান নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া আমেরিকা, চীনের, এবং মুসলিম বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সরকারকে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। দেশ-বিদেশের গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের কৌশলগুলো ঠিক করতে হবে।


খ. জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস
জাতিসংঘে প্রস্তাবের জন্য অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হবে। প্রথমে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতে হবে। বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো রেকর্ডে এখনো স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়নি। এছাড়া যুক্তরাজ্যের ইম্পিরিয়াল ওয়্যার মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের গণহত্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই।

গ. গণহত্যার আধুনিক গবেষণা
একটি দেশের গণহত্যাকে আধনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে যাওয়া অতি জরুরী। সেখানেও আমাদের ঘাটতি রয়েছে। গণহত্যার নিয়ে বেশির ভাগ গবেষণা হয়েছে বাংলায়। গণহত্যা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের উদ্যোগেরও ঘাটতি আছে। তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি।


ব্যাপক জনমত গঠন
বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে যেমন লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বেইজিং, টোকিও, দিল্লি, মস্কো প্রভৃতি স্থানে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। গণহত্যা নিয়ে প্রচুর বই, প্রদর্শনী, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে হবে।

আর্মেনিয়ার গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে প্রায় ১০০ বছর সময় লেগেছে। একাত্তরে যেসব দেশ আমাদের সহায়তা করেছিল, যেমন ভারত, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর লেখক-বুদ্ধিজীবীদের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন। একই সঙ্গে তাদের মহাফেজখানায় যেসব তথ্য-প্রমাণ আছে, সেগুলোও সংগ্রহ করা প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষের দেশ সমূহের সম্মতি: ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল, তাদের অনুরোধ করলেই দেশগুলো তাদের সংসদে প্রস্তাব পাস করবে বলে আশা করা যায়। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওনের মতো ছোট ছোট দেশ তাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারলে, বাংলাদেশ সরকারও আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি অবশ্যই পাওয়া যাবে।

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন