লীগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জ হচ্ছে শান্তি ও সহযোগিতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যা ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্র শক্তির উদ্যোগে লীগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে, প্যারিস শান্তি সম্মেলন শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভবিষ্যত শান্তির ভিত্তি ঠিক করতে লীগ অব নেশনস এর চুক্তি সর্বসম্মতে গ্রহণ করে।
যদিও লীগ অব নেশনস বা জাতিপুঞ্জ তার আশা পূরণ করতে ব্যর্থ ছিল। ফলস্বরুপ, ১৯ এপ্রিল, ১৯৪৬ সালে, জাতিপুঞ্জকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয় এবং এর ক্ষমতা ও কার্যাবলী জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
জাতিপুঞ্জ গঠন
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, প্যারিসে শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে, মিত্রশক্তির দেশগুলো ভবিষ্যতের শান্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম একটি লীগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইড্রো উইলসন তার ১৪ দফার মধ্যে জাতিপুঞ্জ গঠনের জোর দিয়েছিলেন।
লিগ অব নেশনস এর উৎপত্তি হয় প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতির মাধ্যমে। ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে, উইলসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হত্যাকাণ্ডের পর শান্তির জন্য দেওয়া একটি বক্তব্যে জাতিপুঞ্জের ধারণার রূপরেখা দেন।
একই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে, উইলসন তার ১৪ দফাকে ভার্সাই চুক্তিতে পরিণত করতে প্যারিসে চলে যান। সাত মাস পর, তিনি প্যারিস চুক্তি ও জাতিপুঞ্জ গঠনের চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন। তখন মার্কিন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান হেনরি ক্যাবট লজ উভয় চুক্তির বিরোধীতা করেন। লজ বিশ্বাস করেছিলেন যে, প্যারিস চুক্তি এবং লীগ উভয়ই আন্তর্জাতিক বিষয়ে মার্কিন শাসনের অধিকারকে হ্রাস করবে।
ফলস্বরুপ, মার্কিন কংগ্রেস চুক্তিটি অনুমোদন করেনি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগ অব নেশনস এ অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে, অন্যান্য দেশ লীগ অব নেশনস গঠনের ধারণার পক্ষে ছিল।
১৯১৯ সালে, প্যারিস শান্তি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকল দেশ কর্তৃক তৈরি একটি চুক্তিতে লীগের কাঠামো এবং কার্যাবলী তৈরি করা হয়েছিল। জাতিপুঞ্জ সেই বছরেই তার সাংগঠনিক কাজ শুরু করে। এটির সদর দপ্তর প্রথমে লন্ডনের ছিল। পরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। লীগ অফ নেশনস এর চুক্তি ১০ জানুয়ারী, ১৯২০ সালে কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে লীগ অফ নেশনস প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯২০ সালের মধ্যে সংগঠনটিতে ৪৮ টি দেশ যোগদান করেছিল।
জাতিপুঞ্জের কার্যাবলী
একটি সাধারণ পরিষদ, যার মধ্যে ছিল সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতিনিধি দল, একটি স্থায়ী সচিবালয়, যা প্রশাসনিক কার্যাবলী তত্ত্বাবধান করে এবং একটি নির্বাহী পরিষদ নিয়ে জাতিপুঞ্জ গঠিত হয়েছিল।
জাতিপুঞ্জের চারটি স্থায়ী সদস্য (গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং ইতালি) এবং চারটি অস্থায়ী সদস্য ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৩৪ সালে যোগদান করে কিন্তু ১৯৩৯ সালে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করার জন্য বহিষ্কৃত হয়। জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশসমূহ অন্যান্য সকল জাতি-রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতের সমাধানের জন্য কাজ করবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।
লীগ অব নেশনস তার সদস্যদের মধ্যে আঞ্চলিক বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে চেয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত কার্যকর ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২৬ সালে, লীগ মসুল প্রদেশ নিয়ে ইরাক ও তুরস্কের মধ্যে সংঘর্ষের শান্তিপূর্ণ ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে। এছাড়া ১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে, কলম্বিয়া এবং পেরুর মধ্যে সীমান্ত বিরোধের একটি সফল সমাধান করে।
জাতিপুঞ্জের সফলতা ও ব্যর্থতা
১৯২০ সালে রাশিয়া পারস্যের একটি বন্দর আক্রমণ করে, তখন পারস্য লীগের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায়। লীগ এতে অংশ নিতে অস্বীকার করে, বিশ্বাস করে যে রাশিয়া তাদের এখতিয়ার স্বীকার করবে না এবং এটি লীগের কর্তৃত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
এমন কিছু পরিস্থিতি ছিল যেখানে লীগে জড়িত হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত, জাতিপুঞ্জ ফ্রান্স এবং জার্মানির মধ্যে বিরোধপূর্ণ একটি অঞ্চলের ট্রাস্টি বা তত্তাবধায়ক হিসাবে কাজ করেছিল। জার্মানি এবং পোল্যান্ডের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু ডানজিগ, যা ভার্সাই চুক্তি দ্বারা একটি মুক্ত শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জার্মান শাসনের অধীনে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত, জাতিপুঞ্জ বেশ কয়েক বছর ধরে ডানজিগ পরিচালনা করে।
লীগ যেসব বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল তার মধ্যে রয়েছে আলান্দ দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের মধ্যে বিরোধ, হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার মধ্যে বিরোধ, রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের, যুগোস্লাভিয়া এবং অস্ট্রিয়া, আলবেনিয়া ও গ্রিসের মধ্যে সীমান্ত তর্ক, এবং মরক্কো কেন্দ্রীক ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এর তীব্র লড়াই।
১৯২৩ সালে, গ্রিসের সীমানার মধ্যে ইতালীর জেনারেল এনরিকো টেলিনি এবং তার কর্মীদের হত্যা করে। এর পাল্টা প্রতিশোধ নিতে বেনিতো মুসোলিনি গ্রিক দ্বীপ কোরফুতে বোমা হামলা ও আক্রমণ করে। গ্রিস জাতিপুঞ্জ এর কাছে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিল, কিন্তু মুসোলিনি এর সাথে তখন কাজ করতে অস্বীকার করেছিল। লীগ অব নেশনস এর বৃহত্তর প্রচেষ্টা মধ্যে রয়েছে জেনেভা প্রটোকল, যা ১৯২০ -এর দশকে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩৩ সালে সম্মেলন এবং লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে জেনেভা প্রটোকল ব্যর্থ হয়েছিল।
১৯২০ সালে, লীগ একটি ম্যান্ডেটস কমিশন গঠন করে, যারা মূলত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল। আফ্রিকা সম্পর্কে ম্যান্ডেটস কমিশন এর পরামর্শগুলি ফ্রান্স এবং বেলজিয়াম গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করলেও দক্ষিণ আফ্রিকা উপেক্ষা করেছিল।
১৯২৯ সালে, ম্যান্ডেটস কমিশন ইরাককে জাতিপুঞ্জে যোগ দিতে সাহায্য করে। এই কমিশন ফিলিস্তিনে আগত ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে উত্তেজনার মধ্যেও জড়িয়ে পড়েছিল। সেখানে হিটলারের নাৎসি বাহিনী দ্বারা ইউরোপ থেকে ইুহুদি বিতাড়নের ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। ফলে সেখানে শান্তি বজায় রাখা আরও জটিল হয়ে উঠেছিল।
যাইহোক, লীগ শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। তাই, ঐতিহাসিকরা এটিকে একটি দুর্বল, অকার্যকর এবং শক্তিহীন আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে দেখে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link