ওয়াটারলুর যুদ্ধের কারণ
১৮১৫ সালের ১৮ জুন, বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের দক্ষিণে ওয়াটারলু নামক গ্রামে নেপোলিয়ন বাহিনী এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়, ইতিহাসে সেটি ওয়াটারলু যুদ্ধ নামে পরিচিত। ওয়াটারলু যুদ্ধে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয়কে ঘটে।
নেপোলিয়ন ১৯ শতকের গোড়ার দিকে ইউরোপের অনেক অংশ জয় করে। ফরাসি বিপ্লবের সময় নেপোলিয়ন ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা লাভ করেন। তিনি ১৭৯৯ সালে ফরাসি সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন। ১৮০৪ সালে, তিনি ফ্রান্সের সম্রাট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
সম্রাট থাকা অবস্থায় বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে, তিনি পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন। কিন্তু ১৮১৫ সালের ওয়াটারলুর যুদ্ধে, নেপোলিয়নের বাহিনী ব্রিটিশ এবং জার্মান বাহিনী দ্বারা পরাজিত হয়। সেই সাথে তাঁর শাসনামল এবং ইউরোপে ফ্রান্সের আধিপত্যের অবসান ঘটে।
নেপোলিয়নের রাজনৈতিক উত্থান
১৭৬৯ সালে, ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ কর্সিকায় জন্ম গ্রহণ করেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। একটা সময়, ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর পদমর্যাদা দ্রুত বৃদ্ধির মাধ্যমে, তিনি প্রতিভাবান এবং সাহসী নেতা হিসাবে প্রমাণ করেন।
১৭৯৯ সালে, নেপোলিয়ন একটি রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করে। সেই সময় তাঁকে ফ্রান্সের কনসাল বা রাষ্ট্রদূত উপাধি দেওয়া হয়। একই সাথে তিনি ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন।
১৮০৪ সালে, একটি জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সম্রাট হন। নেপোলিয়নের অধীনে ফ্রান্স ইউরোপীয় জাতির বিভিন্ন জোটের বিরুদ্ধে কয়েকটি সফল যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং ফরাসি সাম্রাজ্য পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপে সম্প্রসারণ করেন।
নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণ
১৮১২ সালে, নেপোলিয়ন রাশিয়ায় একটি ধ্বংসাত্মক আক্রমণের নেতৃত্ব দেন, যেখানে তাঁর সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ব্যাপক হতাহতের শিকার হয়। একই সময়ে, ব্রিটিশদের সহায়তায় স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজরা উপদ্বীপ যুদ্ধে (১৮০৮-১৪) আইবেরিয়ান উপদ্বীপ থেকে নেপোলিয়নের বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়।
১৮১৩ সালের লাইপজিগের যুদ্ধে, যা জাতিসংঘের যুদ্ধ নামেও পরিচিত, নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী অস্ট্রিয়ান, প্রুশিয়ান, রাশিয়ান এবং সুইডিশ সৈন্যদের একটি জোটের কাছে পরাজিত হয়েছিল। ১৮১৪ সালে নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে এসে দেখতে পান, জোট বাহিনী প্যারিস দখল করে ফেলেছে।
নেপোলিয়নের নির্বাসন এবং প্রত্যাবর্তন
১৮১৪ সালের ৬ এপ্রিল, নেপোলিয়ন সিংহাসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। Fontainebleau চুক্তির মাধ্যমে, তাঁকে ইতালির উপকূলের কাছাকাছি ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ এলবাতে নির্বাসিত করা হয়।
কিন্তু ১৮১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, নেপোলিয়ন এলবা দ্বীপ থেকে পালিয়ে যান এবং ১০০০ এরও বেশি সমর্থকদের একটি দল নিয়ে ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডে যাত্রা করেন। ২০ মার্চ, তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন, যেখানে জনতা উল্লাসের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়। তখন, নতুন রাজা লুইজ ১৮ পালিয়ে যায় এবং নেপোলিয়ন আবারো ফ্রান্সের ক্ষমতা লাভ করে।
ওয়াটারলুর যুদ্ধ ১৮১৫
ফ্রান্সে নেপোলিয়নের ফিরে আসার পর, মিত্রদের একটি জোট - অস্ট্রিয়ান, ব্রিটিশ, প্রুশিয়ান এবং রাশিয়ানরা ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নেপোলিয়ন একটি নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ পরিচালনার আগে মিত্র বাহিনীকে একের পর এক আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন।
১৮১৫ সালের জুন মাসে, নেপোলিয়নের বাহিনী বেলজিয়ামের দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ জুন, লিগনির যুদ্ধে, নেপোলিয়ন গেবার্ড লেবারেখ্ট ভন এর নেতৃত্বে প্রুশিয়ানদের পরাজিত করেন। তবে, ফরাসিরা সম্পূর্ণভাবে প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করতে পারেনি।
১৮ জুন, নেপোলিয়ন ৭২,০০০ সৈন্য এবং ৬৮০০০ ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের দক্ষিণে ওয়াটারলু গ্রামের কাছে অবস্থান গ্রহণ করে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর মধ্যে ছিল বেলজিয়ান, ডাচ এবং জার্মান সৈন্য। এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ওয়েলিংটনের ডিউক আর্থার ওয়েলেসলি।
ওয়াটারলু যুদ্ধের ফলাফল
নেপোলিয়নের সৈন্যরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোরালো আক্রমণ চালায়। জার্মান বাহিনীর আগমন, ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোড ঘুরিয়ে দেয়। এছাড়া ফরাসি সেনাবাহিনী বিশৃঙ্খলায় পিছিয়ে পড়ে। ওয়াটারলু যুদ্ধে, ফরাসি ৩৩,০০০ এরও বেশি সৈন্য হতাহত হয়েছিল। অপরদিকে, ব্রিটিশ এবং প্রুশিয়ান হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২২,০০০।
বেলজিয়াম অভিযানের সময়, নেপোলিয়নের ক্লান্ত এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে কৌশলগত অনেকগুলো ভুল করেনএবং সিদ্ধান্তহীনভাবে কাজ করেন। ফলে, ওয়াটারলু যুদ্ধে নেপোলিয়ন বাজেভাবে পরাজিত হন, এবং শেষ পর্যন্ত, এই যুদ্ধের মাধ্যমে নেপোলিয়নের সামরিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে।
১৮১৫ সালের ২২ জুন, নেপোলিয়ন পুনরায় পদত্যাগ করেন। অক্টোবরে, তাঁকে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের প্রত্যন্ত ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত করা হয়। তিনি ১৮২১ সালের ৫ মে, সেন্ট হেলেনা দ্বীপে মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link