ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমি এবং একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব নিয়ে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ, পাকিস্তানের লাহোরে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রি আবুল কাশেম ফজলুল হক ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। যা ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত।
লাহোর প্রস্তাব কি?
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মুসলমানগণ ব্রিটিশ দ্বারা বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত, শোষিত হতে থাকে। এছাড়া ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে, হিন্দু জমিদার, নায়েব, মহাজন কর্তৃক মুসলমানরা প্রায় সময় শোষণ নির্যাতনের কবলে পড়ত।
১৯২০ সালের পর থেকে, ভারতে একটি শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে থাকে। ব্রিটিশরা এসব আন্দোলন নানাভাবে প্রতিহত করে।
দীর্ঘ পনের বছর ধরে চলা এই আন্দোলন নিরসন করতে ৩ টি গোল টেবিল বৈঠক সহ বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার পর, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ করে ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু ভারত শাসন আইনের জটিলতা থাকায় এটি সেসময়ের জনপ্রিয় দুটি দল মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসকে সন্তুষ্ঠ করতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরুপ, রাজনৈতিক অস্থিরতা আগের চেয়ে কয়েকগুন বেড়ে যায়।’
ভারত শাসন আইন কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ১৯৩৫ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ১১ টি প্রদেশের মধ্যে ৭ টিতে কংগ্রেস জয় লাভ করে। বাংলা এবং পাঞ্জাব প্রদেশে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুযায়ী, কংগ্রেস সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করার কথা, কিন্তু কংগ্রেস মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে একক মন্ত্রিসভা গঠন করে।
মুসলিম লীগ বাংলা ও পাঞ্জাবের সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। এতে, মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে একটি বৈরিতা সৃষ্টি হয়। তখন কংগ্রেস পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু তাঁর একদর্শী নীতি প্রতিষ্ঠা করে। ফলস্বরুপ, ভারতীয় উপমহাদেশে পুনরায় হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
আরো পড়ুন, ছয় দফা কি? ৬ দফার দাবিসমূহ
কংগ্রেস শাসিত প্রদেশ গুলোর আইন আদালত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কংগ্রেসের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংগীত হিসেবে বন্দেমাতরম কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নেহেরু এক ঘোষণায় বলেন, ‘‘ভারত উপমহাদেশে শুধুমাত্র দুটি দল বিদ্যামান- কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকার। অপরাপর সকল দলই কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত।‘‘
কংগ্রেসের এমন মনোভাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। তিনি ১৯৩৯ সালে, মুসলিম লীগ পুনর্গঠন করে দ্বি জাতি তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, না, ভারতে দুটি দল নয়, তৃতীয় আরো একটি দল আছে। আর সেটি হচ্ছে মুসলিম লীগ-মুসলমানদের দল। তারা একটি স্বতন্ত্র জাতি।’’
এই স্বতন্ত্র জাতির ঘোষনার পর থেকেই মুসলমানগণ একটি স্বাধীন আবাসভূমি গঠনের ভাবনা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুটি পৃথক হিন্দু মুসলিম আবাসভূমির জন্য ব্রিটিশদের নিকট দাবি তোলা হয়। জিন্নাহ তখন ঘোষণা করেন, ‘‘ক্ষুদ্র দায়িত্ব এবং স্বল্প ক্ষমতা প্রয়োগে যে সীমিত ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা স্পষ্টত এটাই প্রমাণ করেছে যে, হিন্দুস্তান শুধু হিন্দুদের জন্য।’’
এছাড়া জিন্নাহ আরো বলেন, ‘‘হিন্দু-মুসলিম দুটি পৃথক জাতি। সুতারাং মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র থাকা প্রয়োজন। ফলস্বরুপ, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ, লাহোরে মুসলীম লীগের এক অধিবেশনে শেখ ফজলুল হক উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবি সম্বলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। ইতিহাসে এটি লাহোর প্রস্তাব হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ২৪ মার্চ, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে উক্ত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়,
Resolved that it is the considered view of this session of the All Indian Muslim league that the area in which the Muslims are numerically in a majority as in the North-western and Eastern zones of India should be grouped to constitute ‘’Independent states’’ in which constituent units shall be autonomous and sovereign’’
আরো পড়ুন, মৌলিক গণতন্ত্র কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য
১. ‘‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনারায় গোষণা করছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা রয়েছে তা এদেশের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।’’
২. ‘‘সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ঠ হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।’’
৩. ‘‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এ অধিবেশনের ইহাই সুচিন্তিত অভিমত যে, ম্মিরিখিত মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত না হলে ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকরী করা যাবে না বা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।’’
ভৌগলিক অবস্থান অনুসারে সন্নিহিত ইউনিটগুলোকে পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করকে হবে।
৪. এ সব অঞ্চলকে প্রয়োজনমত সীমা পরিবর্তন করে এমনভাবে করতে হবে যাতে ভারত বর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সে সব অঞ্চলসমূহে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৫. এ সব স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রদেশগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।
৬. এ সব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় , সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যন্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধান কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে।
৭. ভারতবর্ষের অন্যন্য অংশে যেকানে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সেখানে তাদের ও অন্যন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যন্য অধিকার ৈএবং স্বার্থ রক্ষার জন্য তাদের সাথেত পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিদানে পর্যাপ্ত, কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে।
আরো পড়ুন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য
লাহোর প্রস্তাবের ফলাফল
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করার পর ভারতের শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা লাভ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা এক নতুন প্রেরণার সন্ধান ও স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় আশান্বিত হয়। লাহোর প্রস্তাবের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয়। তারা পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলতে মুরু করে। অপরদিকে, লাহোর প্রস্তাবে ভিত্তিতে ভারতবর্ষের পৃথক হওয়ার বিষয়টি হিন্দু সম্প্রদায় মেনে নিতে পারে নি। তাই তারা বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি করে।
এ প্রস্তাবের পর, মুসলীম লীগকে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিক নির্দেশনা এনে দেয়। লাহোর প্রস্তাব তখন পাকিস্তান প্রস্তাবে পরিণত হতে শুরু করে। ১৯৪৬ সালে, দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লেজিসলেটরস কনভেনশনে মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্রের পরিকল্পনার পরিবর্তে এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ দেখতে পায়। লাহোর প্রস্তাবে প্রতিক্রিয়ায় মহাত্মা গান্ধী বলেন, ‘‘লাহোর প্রস্তাব মেনে নেওয়ার অর্থ ভারতকে ব্যবচ্ছেদ করা এবং তা হবে একটি পাপ কাজ।’’
নেহেরুর মতে, ‘‘লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলে ভারত হয়ে যাবে বলকান রাষ্ট্রগুলোর মত ছোট ছোট বিভক্ত কর্তৃত্ববাদী পুলিশী রাষ্ট্র।’’
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে পর থেকেই ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক হামলা লেগে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের উপনিবেশিক শাসন তুলে নেয়। সে হিসেবে, ভরতবর্ষের হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা হামলার মুখে তারা ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিশেষে, ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link