সার্ক কি?
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির একটি সংগঠন যা ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে এটি গড়ে উঠে। সার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশগুলো হল বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা।
আফগানিস্তান ২০০৭ সালে সার্কের সদস্যপদ লাভ করে। সার্কের সদর দপ্তর নেপালের কাঠমান্ডুতে অবস্থিত। সার্ক ১১ টি সেক্টরে পরস্পরের সহযোগিতা করে থাকে ক্ষেত্রসমূহ হল, ১. কৃষি, ২. শিক্ষা, ৩. সংস্কৃতি, ৪. খেলাধুলা, ৫. স্বাস্থ্য, ৬. জনসংখ্যা এবং শিশু কল্যাণ, ৭. পরিবেশ এবং আবহাওয়া, ৮. গ্রামীণ উন্নয়ন, ৯. পর্যটন, পরিবহন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, যোগাযোগ, ১০. নারী উন্নয়ন , ১১. এবং মাদক পাচার ও মাদকের অপব্যবহার রোধ।
সার্ক কখন গঠিত হয়?
৮ ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সালে, ঢাকায় সার্ক সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির ইংরেজি নাম South Asian Association for Regional Cooperation Or (SAARC)।
দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি সর্বপ্রথম ১৯৮০ সালে উত্থাপিত হয়। ১৯৮১ সালের এপ্রিলে, ৭ টি প্রতিষ্ঠাতা দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র সচিবগণ কলম্বোতে মিলিত হন। সার্কের প্রথম মহাসচিব ছিলেন বাংলাদেশের আবুল হাসান।
সার্কের গঠন
সার্ক সনদে এ সংস্থার জন্য একটি পাঁচ স্তর বিশিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিধান রাখা হয়েছে। এই কাঠামোগুলো হচ্ছে,
১. সদস্য দেশসমূহের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন: সার্ক সনদ অনুযায়ী প্রতি বছরই এই শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা। নিয়ম অনুযায়ী সব সদস্য রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হতে পারে না। প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত সার্কের ১৬ টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
২. পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন: সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সাধারণত বছরে দু’বার মিলিত হন। ২বার সম্ভব না হলে বছরে অন্তত একবার মিলিত হবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনগুলোতে বিভিন্ন এজেন্ডা ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা হয়।
৩. স্ট্যান্ডিং কমিটি: সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্র সচিবদের সমন্বয়ে মূলত স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠিত। সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোর পরিকল্পনা, অনুমোদন, তদারকি ও সমন্বয় সাধন এ কমিটির প্রধান কাজ। এ কমিটি প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনো সময় বৈঠকে বসবেন এবং সংস্থার কার্যাবলী সম্পর্কে স্বস্ব দেশের মন্ত্রিপরিষদের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করবেন।
৪. টেকনিক্যাল কমিটি: সার্কের কর্মসূচিগুলো কতোগুলো নির্দিষ্ট সহযোগিতার ক্ষেত্রের মাধ্যমে পরিচালিত। এসব কর্মসূচি টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নিয়ে এ কমিটি গঠিত।
৫. সচিবালয়: সার্ক সনদের ৮নং ধারায় সার্ক সচিবালয় গঠনের কথা বলা আছে। ভারতের বাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত সার্কের দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে সচিবালয়ের গঠন ও কার্যাবলী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্ক সচিবালয় স্থাপন করা হয়। সর্বপ্রথম, ১৯৮৭ সালে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সার্কের কর্মকান্ড পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে সচিবালয় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে।
সার্কের মূলনীতি
সার্কের নীতি হবে পারস্পরিক সহযোগিতা। এছাড়া সার্বভৌম রক্ষা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং পারস্পরিক সুবিধার নীতির প্রতি শ্রদ্ধা।
সার্কের অন্যন্য মূলনীতিগুলো হলো:
১. সার্কের যে কোনো সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হতে হবে।
২. দ্বিপক্ষীয় বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো এ সংস্থায় তোলা যাবে না।
৩. সদস্য রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে, কেউ কারো অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। তদুপরি, তারা পারস্পরিক প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।
৪. এ অঞ্চলের দেশগুলোর আশা-আকাঙ্খার প্রতি লক্ষ্য রেখে সার্ক ভূমিকা পালন করবে।
সার্কের সহযোগিতার ক্ষেত্র
সার্কের পর্যবেক্ষক দেশ
বর্তমানে সার্কের নয়টি পর্যবেক্ষক দেশ রয়েছে। যথা: (১) অস্ট্রেলিয়া, (২) চীন, (৩) ইউরোপীয় ইউনিয়ন, (৪) ইরান, (৫) জাপান, (৬) কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, (৭) মরিশাস, (৮) মিয়ানমার, এবং (৯) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সার্কের কার্যাবলী
সার্কের কার্যাবলীর মধ্যে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত। যথা,
- মানব সম্পদ উন্নয়ন
- কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন
- পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এবং জৈবপ্রযুক্তি
- অর্থনৈতিক, বাণিজ্য এবং অর্থ
- সামাজিক বিষয়
- তথ্য এবং দারিদ্র্য বিমোচন
- শক্তি, পরিবহন, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি
- শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি
সার্কের উদ্দেশ্য
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কল্যাণ এবং তাদের জীবনমান উন্নতকরণ করা। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করা। প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদায় বেঁচে থাকার এবং তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করার সুযোগ প্রদান করা।
দেশগুলোর মধ্যে সম্মিলিত স্বনির্ভরতা প্রচার ও শক্তিশালী করা। পারস্পরিক বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং একে অপরের সমস্যার সমাধানে অবদান রাখা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সহায়তার বৃদ্ধি করা। উন্নয়নশীল দেশ ও আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক বিভিন্ন সংস্থার সাথে সহযোগিতা জোরদার করা। সাধারণ স্বার্থের বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা।
সার্ক সচিবালয়
১৬ জানুয়ারি, ১৯৮৭ সালে, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সার্ক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির মূল কাজ হলো সার্ক কার্যক্রম বাস্তবায়নের সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ, সমিতির সভা এবং সার্ক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা।
সচিবালয়ে গঠিত হয় একজন মহাসচিব, ৭ জন পরিচালক এবং কিছু সাধারণ কর্মী দ্বারা।
সার্ক বিশেষায়িত সংস্থা
১. সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (SDF): এর প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন ইত্যাদি প্রকল্প ভিত্তিক সহযোগিতার অর্থায়ন। সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বোর্ড দ্বারাি এটি পরিচালিত হয়।
২. সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (SAU): সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি (SAU), সার্কের একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা ভারতে অবস্থিত। এটির প্রদত্ত ডিগ্রী এবং সার্টিফিকেট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত সংশ্লিষ্ট ডিগ্রী এবং সার্টিফিকেটের সমান।
আরো পড়ুন, ন্যাটো কি? ন্যাটো গঠনের ইতিহাস ও দেশসমূহ
৩. দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মান সংস্থা: সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজেশন (সারসো) এর সচিবালয় ঢাকায় অবস্থিত। এটি সার্ক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মানোন্নয়ন এবং সামঞ্জস্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সমন্বয় ও সহযোগিতা অর্জন এবং বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া এর উদ্দেশ্য ছিল আন্ত-আঞ্চলিক বাণিজ্যকে সহজতর করা, এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার লাভের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ মান তৈরি করা।
৪. সার্ক সালিসী পরিষদ: এটি একটি আন্ত সরকারি সংস্থা, যার কার্যালয় পাকিস্তানে। শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংকিং, বিনিয়োগ এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিবাদগুলোর সুষ্ঠু ও দক্ষ নিষ্পত্তির জন্য এই অঞ্চলের মধ্যে একটি আইনি কাঠামো করার জন্য বাধ্যতামূলক সার্ক সালিসী পরিষদ গঠিত হয়।
সার্কের আঞ্চলিক সংস্থাসমূহ
- সার্ক কৃষি তথ্য কেন্দ্র: এটি ১৯৮৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
- সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র: ১ জানুয়ারী ১৯৯৫ সালে এর কার্যক্রম শুরু হয়। এটি ঢাকার আগারগাঁয়ে অবস্থিত।
- সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়: এটি ভারতের নয়াদিল্লীতে অবস্থিত।
- সার্ক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র: এর সদর দপ্তর শ্রীলঙ্কায় অবস্থিত।
- সার্ক মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র: এটির সদর দপ্তর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে।
- সার্ক তথ্য কেন্দ্র: সদর দপ্তর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে অবস্থিত।
আরো পড়ুন, জাতিসংঘ গঠনের ইতিহাস ও কার্যাবলী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link