আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত : গঠন ও কার্যাবলী

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কি

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (International Criminal Court, ICC) হল একটি আন্তঃসরকারি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান যেটি নেদারল্যান্ডস এর শহর হেগে অবস্থিত। এটি প্রথম এবং একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত যেখানে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধের মত আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য গঠন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (১৯৯৮) রোম সংবিধি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক সংস্থা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ১২৩টি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) এর ১১ তম সদস্য রাষ্ট্র। এটির বিচারকের সংখ্যা ১৮ জন এবং বিচারকগণের মেয়াদ নয় বছর।

প্রতিষ্ঠার কারণ

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিদ্যমান কোন দেশের জাতীয় বিচার ব্যবস্থার পরিপূরক করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাই এটি শুধুমাত্র তখনই তার এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে যখন জাতীয় আদালত অপরাধীদের বিচার করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম হয়। আইসিসির শুধুমাত্র সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘটিত অপরাধ, সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আদালতে উল্লেখ করা পরিস্থিতিতে অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত : গঠন ও কার্যাবলী, azhar bd academy

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত যা সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তদন্ত, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত। এটি প্রধানত গণহত্যার অপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধ নিয়ে মামলা পরিচালনা করে।

গত এক শতাব্দিতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২৬০টিরও বেশী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এতে ৬ মিলিয়নেরও বেশী মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। যার অধিকাংশ নারী, শিশু এবং বেসামরিক নাগরিক। ১৭০ মিলিয়নেরও বেশী মানুষ তাদের স্বাবর অস্থাবর সহায় সম্পত্তি হারিয়েছে। এসকল যুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধের মত নিকৃষ্ট অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, কিন্তু এসবের কোন বিচার হয় নি।

যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রনয়ন এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রোটোকল প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও তা বাস্তবে প্রয়োগে ব্যর্থ হয়। ফলে ভবিষ্যৎ স্বৈর শাসক, তাদের কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীদের মানবাধিকার বিরোধী অপরাধ থেকে নিবৃত করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

এই লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের ১৫ জুন থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ইতালির রোম নগরে সমগ্র বিশ্বের ১২০টি দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কুটনীতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবং ১২০-৭ ভোটের বিপূল ব্যবধানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সংবিধি বা রোম সংবিধি গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে, কিছু সংখ্যক রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধিটি অনুমোদিত হওয়ায় ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

আন্তর্জাতিক আদালতের গঠন

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চারটি প্রধান অঙ্গ রয়েছে। যথা-
প্রেসিডেন্সি, 
বিচার বিভাগ, 
প্রসিকিউটর অফিস এবং 
রেজিস্ট্রি। 

রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্সি হলেন বিচার বিভাগীয় বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক যিনি আদালতে মামলার শুনানি করে। প্রসিকিউটরের কার্যালয় প্রসিকিউটরের নেতৃত্বে থাকে যিনি অপরাধ তদন্ত করেন এবং বিচার বিভাগীয় বিভাগের সামনে ফৌজদারি কার্যক্রম শুরু করেন। রেজিস্ট্রির নেতৃত্বে রেজিস্ট্রার এবং প্রধান কার্যালয়, আটক ইউনিট এবং পাবলিক ডিফেন্স অফিস সহ ICC-এর সমস্ত প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনার জন্য নিযুক্ত থাকে।

সদর দপ্তর

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC) হল একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। এটির সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে এ আদালতটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কার্যাবলী

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত জাতীয় আদালতের উপর কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারে না। বরং জাতীয় বিচার ব্যবস্থাকে সহযোগিতা করে থাকে। কেননা রোম সংবিধিতে উল্লেখিত সবগুলো অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারের প্রথম দায়িত্ব জাতীয় আদালতের এবং জাতীয় আদালত সে অপরাধের তদন্ত ও বিচার করবে। শুধুমাত্র যে সকল রাষ্ট্র উক্ত অপরাধের বিচার করতে অপারগে এবং আগ্রহী নয় সেসকল অপরাধের বিচার করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।

২০০৪ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করার মাধ্যমে সর্বপ্রথম সংস্থাটি কার্যক্রম শুরু করে। একই বছর মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা সংস্থাটিতে হস্তান্তর করা হয় এবং ২০০৭ সালে এর তদন্ত শুরু করা হয়। ২০০৫ সালে সুদান ও উগান্ডায় যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে আন্তর্জাতিক আদালত। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে সংস্থাটি।

২০১০ সালে কেনিয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধ।
২০১১ সালে আইভরি কোস্টে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত।
২০১১ সালেই লিবিয়ায় যুদ্ধপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত।
এছাড়া আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কলম্বিয়া, জর্জিয়া, গিনি, ইরাক, নাইজেরিয়া ও ইউক্রেনে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখছেন সংস্থাটির প্রসিকিউটররা।

প্রতিষ্ঠার পর, আইসিসি এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত করেছে। এদের মধ্যে রয়েছে উগান্ডার বিদ্রোহী নেতা জোশেফ কোনি, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফি ও আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লরেন্ট জিবাগবো।

এ আদালতে বিচারের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে। অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য শাস্তিসমূহের মধ্যে রয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ইত্যাদি। তবে, সংস্থাটির মৃত্যুদণ্ড দেয়ার এখতিয়ার নেই। এছাড়া এ আদালত জরিমানা ধার্য ও সংশ্লিষ্ট অপরাধের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ বা সম্পত্তি বাযেয়াপ্ত করার নির্দেশ প্রদান করতে পারে। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করার জন্য আদালত সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে অনুরোধ করতে পারে এবং অনুরোধ প্রাপ্ত দেশ তা মেনে চলতে বাধ্য। অন্যথায় তা আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন বলে গন্য হয়

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন