আরব বসন্ত কি?
২০১০ সাল থেকে আরবের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রপন্থীদের যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল তাকে আরব বসন্ত বলে। আরব বসন্তের সূতিকাগার বা উৎপত্তিস্থল হচ্ছে তিউনিসিয়া।
তিউনিসিয়া থেকেই প্রথম শুরু হয়েছিলো আরব জাগরণ। আর জাগরণের ধাক্কায় টালমাটাল হয় আরব বিশ্বের স্বেচ্ছাচারী শাসনের ভিত্তিমূল। তবে আরব জাগরণের ধাক্কায় অধিকাংশ আরব দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও, বিপ্লবের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত তিউনিসিয়ায় আরব বসন্তের ফুল কিন্তু ঠিকই ফুটছে পূর্ণ বিকশিত রূপে।
২০১১ সাল নাগাত মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব সর্বত্রই বিস্তার লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এসব আন্দোলন ও বিক্ষোভকে ‘আরব বসন্ত’ বলে প্রচার করে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো।
আরব বসন্তের ইতিহাস শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। তখন আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বয়ে যাওয়া গণবিপ্লবের ঝড়কে পশ্চিমা সাংবাদিকরা আরব বসন্ত হিসাবে আখ্যায়িত করে। প্রথম গণবিক্ষোভের শুরু মিশরে, এরপর তা লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মিশরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পতন হয়। পরে লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি শাসনের অবসান হয়।
আরব বিশ্বের এই গনঅভ্যূত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটাতে সাহয়ক ভূমিকা রেখেছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, আরব বসন্তের ফলে মাত্র দুই বছরে লিবিয়া, সিরিয়া, মিশর, তিউনিসিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেনের গণ-আন্দোলনের ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে দুই হাজার ৫৬ কোটি ডলার।
আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরণের বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল এবং ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সুদান, সিরিয়াতে ছোট বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। এসব বিদ্রোহে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা, র্যালি প্রভৃতি কর্মসুচী নেয়া হয়।
আরব বসন্তের কারণ
আরব বসন্তের সূচনা হয় তিউনেশিয়ায়। স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর দুঃশাসনের ফলে সেই দেশে বেকারত্বের হার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। এর প্রতিবাদে এক যুবক প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহুতি দেয়। ফলাফলস্বরুপ, লোকজন বেন আলীকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমে পড়ে। ফলে সূচনা হয় আরব বসন্ত। যদিও তিউনিসিয়ায় এটিকে জেসমিন বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা হয়।
এরই মধ্যে তিউনিসিয়া, এবং মিশরে গণবিদ্রোহের ফলে স্বৈরশাসকদের পতন আরম্ভ হয়।আরব বসন্তের কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে সরকারি দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার লংঘন, বেকারত্ব এবং চরম দারিদ্র্যের অভিযোগের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং খরার প্রকোপ।
আরব বিশ্বে চরম রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দুর্বল অর্থনীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য ও শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ যুবসমাজ, খরা ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়ছিল।
মিশরের গণবিক্ষোভ
আরব বিশ্বে সর্বপ্রথম গণবিক্ষোভের শুরু হয়েছিল মিশরে। মাত্র ১৭ দিনে পতন হয় রাষ্ট্রপতি হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসন। ২০১০-এর শুরুতে প্রথম গণবিক্ষোভ ছিল মিশরীয় জনগণের দীর্ঘকালের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। ১৭ দিন গণআন্দোলনের পর ১১ই ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারকের পতন হয়। ঐ দিন মিশরের সমস্ত মানুষ স্বৈরাচারি হোসনি মোবারকের অপসারণের দাবিতে গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
১৯৮১ সালে, হোসনি মোবারক ক্ষমতায় আসার পর থেকে মিশরে কার্যত সেনাবাহিন সমর্থিত একনায়কতন্ত্র সূচনা হয়। তবে, মিশরীয় সেনাবাহিনী মোবারকের পক্ষ ত্যাগ করে জনগণের পক্ষাবলম্ববন করার সিদ্ধান্ত নিলে দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটে।
তিউনিশিয়ায় গণবিক্ষোভ
২০১১-এর শুরুতে আফ্রিকার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি তিউনিশিয়ার গণঅভ্যূত্থানে ২৪ বছরের একচ্ছত্র রাজত্বের জাইন-এল আবেদিন বেন আলীর পতন ঘটে।
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ
লিবিয়ায় গণবিক্ষোভ চলে প্রায় ৯ মাস। ২০১১-এর ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ ও লড়াই শুরু হয়। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে, দেশের বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বেনগাজিতে একটি থানার কাছে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এ দিনটিকে ‘দ্য ডে অব রিভোল্ট’ বলা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি, বিদ্রোহীরা বেনগাজি শহর দখল করে নেয়। মার্চের ১০ তারিখে, গাদ্দাফি বাহিনী ব্রেগা শহরে বোমাবর্ষণ শুরু করে। বিদ্রোহীদের কাছ থেকে জায়িয়াহ ও বিন জাওয়াদ শহর পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ২০ অক্টোবর, সিরত শহরে লড়াইয়ে নিহত হন গাদ্দাফি।
আরব বসন্তের ফলাফল
১. আরব বসন্তের ঢেউ সরাসরি এসে আছড়ে পড়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ তিউনেশিয়া, মিশর, ইয়েমেন, বাহারাইন, লিবিয়া ও সিরিয়া। সেই সাথে সমাপ্ত হয়েছিল প্রভাবশালী শাসকদের দীর্ঘ দিনের ক্ষমতা।
২. প্রায় দেড় লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
৩. তিউনেশিয়ায় স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর পতনের পর ক্ষমতায় আসে ইসলামিক দল ‘ইনাহদাহ’। তিউনিশিয়ায় স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে প্রায় ৩৩৮ জন নিহত হয়।
৪. প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটায়। এতে কমপক্ষে ১৭০০ মিশরীয় প্রাণ হারায়।
৫. ইয়েমেনে দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে জনগণ ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। সালেহ প্রায় ৩৪ বছর ইয়েমেন শাসন করেছিল। আরব বসন্তে ইয়েমেনে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যায়।
৬. লিবিয়ায় কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফির দীর্ঘ ৪২ বছরের সামরিক শাসনের অবসান হয়। এই আন্দোলনে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link