চাকমা বিদ্রোহ
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পরবর্তী, প্রায় দুইশত বছর ধরে সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজরা শাসন করেছে। ইংরেজদের দীর্ঘদিনের শাসনে বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ বারবার প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, এবং শেষে যুদ্ধ করেছে। বাংলার ইতিহাসে তিতুমীর বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম বিদ্রোহ তার উদাহরণ।
কিন্তু, এসব বিদ্রোহ ছাড়াও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে অসংখ্য আন্দোলন-বিপ্লব হয়েছে, যার ইতিহাস এদেশের অধিকাংশ মানুষই জানে না। এরকম একটি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ছিল চাকমা বিদ্রোহ যা ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল।
চাকমা বিদ্রোহের ইতিহাস
স্বাধীন সুলতানি আমলে, মুঘল শাসনামলে এবং পরবর্তী স্বাধীন নবাবী শাসনামলে বাংলাদেশের সুলতান, সুবাদার এবং নবাবদের মধ্যে চাকমা রাজার সাথে সম্পর্ক ছিল সহজাত। চাকমা রাজা বাংলাদেশের শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং তাদের বশ্যতার চিহ্ন হিসেবে সীমিত পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করত।
চাকমারা সাধারণত পণ্য ব্যবসার ব্যবসা করত। এ কারণে চাকমা রাজা মুদ্রার পরিবর্তে পণ্যের মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধ করতেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের শাসকদেরকে চাকমা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত রাখা হয়। তাদের অধীনে চাকমারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পৃক্ত হয়। ১৭৬০ সালে, ইংরেজরা মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিমকে বাংলাদেশের নতুন নবাব ঘোষণা করে। বিনিময়ে মীর কাসিম ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেওয়ানি আদায়ের ক্ষমতা প্রদান করেন। ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে আসে।
সুলতানি, মুঘল ও নবাবের শাসনামলে চাকমাদের ওপর কর ছিল খুবই সীমিত। কিন্তু ১৭৬১ সাল থেকে ইংরেজরা রাজস্বের হার বাড়াতে থাকে। শুধু তাই নয়, ইংরেজরা তাদের স্বভাব অনুযায়ী চাকমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। ১৭৭২-৭৩ সালে, ইংরেজরা চাকমাদের মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব দিতে বাধ্য করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি মুদ্রা ভিত্তিক অর্থনীতি প্রবর্তনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ফলে, চাকমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নানা সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে। ধীরে ধীরে চাকমারা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। ১৭৭৭ সালে, ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজস্বের হার আরো বৃদ্ধি করে এবং রাজস্ব সংগ্রহের জন্য চুক্তিভিত্তিক ইজারাদার নিয়োগ করে।
সেসময় চাকমাদের রাজা ছিলেন জোয়ান বক্স এবং প্রধান নায়েব ছিলেন রুনু খান। রুনু খানকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ১৭৭৭ সালে ইংরেজরা রাজস্বের হার বাড়ালে রুনু খানের পক্ষে আদায় করা সম্ভব ছিল না। ইংরেজরা রুনু খানের উপর নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে লাগল। ফলে, অসন্তোষের মাত্রা চরম আকার ধারণ করে।
১৭৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজা জোয়ান বক্সের অনুমতিক্রমে রুনু খান ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রনু খান স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ইংরেজ ও ইংরেজদের অনুগত কর্মচারীদের বিতাড়িত করেন। রুনু খানের বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বারবার পার্বত্য চট্টগ্রামে সৈন্য পাঠায়, কিন্তু প্রতিবারই তাদের অভিযান শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।
বিপুল সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্রের মোকাবিলায় রুনু খান গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেন। প্রতিটি যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যরা চাকমা বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। ১৭৮০ সালে, ইংরেজ অভিযান সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশ, চাকমাদের সীমাহীন সাহস এবং রুনু খানের কৌশল- এই তিনটির কাছে ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে চাকমাদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজরা চাকমাদের অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ১৭৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ চট্টগ্রাম থেকে লবণ, মাছ, শুঁটকি, লোহার পণ্য, মৃৎপাত্র ইত্যাদি আমদানি করত। ইংরেজরা এসব পণ্য সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে কঠোরভাবে অবরোধ আরোপ করে।
অন্যদিকে, রুনু খান উন্মাদ হয়ে ইংরেজদের ওপর পাল্টা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। সেসময় লবণের ব্যবসা ছিল ইংরেজদের প্রধান ব্যবসা। ভূমি রাজস্বের পর লবণ ব্যবসা ছিল তাদের আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস। ইংরেজদের লবণ উৎপাদনের প্রধান উৎস ছিল চট্টগ্রামে, এবং এই লবণ উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানী কাঠ আসত পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে। রুনু খানের জ্বালানি কাঠ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ইংরেজরা চাকমাদের শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেদের অর্থনীতির বারোটা পেল।
পরবর্তীতে আরো কয়েকটি অভিযানে ইংরেজরা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। ১৭৮২-৮৫ সালের মধ্যে পাঠানো তাদের দুটি বড় সেনা সৈন্য চাকমাদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ইংরেজদের ব্যর্থতা এবং চাকমাদের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে ইংরেজরা মারাত্মক সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজার সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
১৭৮৭ সালের শান্তি চুক্তির শর্তাবলীর
- ইংরেজরা একটি নির্দিষ্ট হারের রাজস্বের বিনিময়ে চাকমাদের অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা স্বীকার করবে।
- অর্থপ্রদানের পদ্ধতি পূর্বের মত অর্থাৎ পণ্যের মাধ্যমে পরিশোধ।
- ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমভূমি থেকে অভিবাসন বন্ধ করতে সম্মত হয়।
- ইংরেজরা চাকমা রাজ্যকে আরাকান বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চাকমা রাজাকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল এবং এই কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু ইংরেজ সৈন্য মোতায়েন করা হয়।
এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১০ বছর ধরে চলা চাকমা বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়। বিদ্রোহের অবসানের সাথে সাথে ইংরেজরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অন্যদিকে, চাকমারা তাদের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link