সাঁওতাল বিদ্রোহ
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারতে সংঘটিত একটি ঔপনিবেশিক ও জমিদারি শাসন-বিরোধী আন্দোলন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে সাঁওতালদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা প্রথম সোচ্চার হয়। হতাশাগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ সাঁওতালরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তাদের নিজস্ব সৈন্যবাহিনী গঠন করে যার মধ্যে কৃষক, গ্রামবাসী এবং মহিলারা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হওয়া বিদ্রোহে সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কিন্তু ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক বন্দুক ও কামানের কাছে সাঁওতালরা টিকতে পারেনি। এ-যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা মারা যায়। বিদ্রোহে সাঁওতাল প্রধান নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব নিহত হলে, ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় এবং সেইসাথে সাঁওতাল বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ
১৮৫৫ সালের ৩০ জন, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায় বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। ব্রিটিশদের বিভিন্ন নীতি সাঁওতালদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অতিষ্ট করে দেয়। এই বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ ছিল। নিম্মে সাঁওতাল বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ আলোচনা করা হল।
ইংরেজ শাসনামলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন, ইংরেজদের রাজস্ব বৃদ্ধি ও কৃষি নীতির বিরুদ্ধে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে। রাজস্ব ব্যবস্থা জমিদারকে তাদের ইচ্ছামতো কৃষকদের শোষণ করার ক্ষমতা দিয়েছিল। যার ফলে, দেশের অনেক জায়গায় অসন্তোষ তৈরি হয়। ব্রিটিশদের বিভিন্ন নীতি সাঁওতালদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অতিষ্ট করে দেয়।
ব্রিটিশদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সাথে সাঁওতালদের রাজস্ব অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত, সাঁওতালরা এমন একটি পরিস্থিতিতে আটকা পড়েছিল যেখানে তাদের কাছে ব্রিটিশ এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একমাত্র বিকল্প ছিল, যা সাঁওতাল বিদ্রোহের দিকে নিয়ে যায়।
১৭৯৩ সালের স্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থার অধীনে, জমির মালিকদের জমির উপর চিরস্থায়ী এবং বংশগত অধিকার ছিল যতক্ষণ না তারা ব্রিটিশ সরকারকে একটি নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদান করত। কৃষকরা তাদের খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে, ব্রিটিশরা সাঁওতালদের জমির বিশাল অংশ নিলাম করে যে কেউ তাদের নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদান করত এবং এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু উপজাতীয় জমি বিক্রি করা হয়েছিল। সাঁওতালরা জমির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, এবং তাদের পুরানো উপজাতীয় ব্যবস্থা এবং প্রজন্ম ধরে চলমান রাজনৈতিক কাঠামোর অবসান ঘটে।
সাঁওতাল বিদ্রোহের আরেকটি কারণ ছিল বিনিময় প্রথার অনুসরণ। এর জন্য, তারা জমিদারদের নগদ অর্থ প্রদান করতে সমস্যায় পড়েছিল। ফলস্বরূপ, তাদেরকে মহাজনদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে টাকা ধার করতে হয়। যা শেষ পর্যন্ত, তাদের একটি পৈশাচিক ঋণের ফাঁদে ফেলেছিল। এই চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সাঁওতালদের অস্তিত্ব বাঁচানোর একমাত্র সমাধান ছিল ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল
সাঁওতাল বিদ্রোহের পর ইংরেজ ঔপনিবেশিক সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করে। বিদ্রোহ পরবর্তীকালে, ভাগলপুর ও বীরভূমের কিছু অংশ নিয়ে ৫, ৫০০ বর্গ মাইল জুড়ে সাঁওতাল পরগণা জেলা গঠিত হয়। এই পরগণাকে অনিয়ন্ত্রিত (নন- রেগুলেটেড) একটি জেলা ঘোষণা করা হয়।
প্রথমে এই জেলার নাম হয় ডুমকা যেটি পরবর্তীতে সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত হয়। এখানে সাঁওতাল মানঝি্, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারি কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়।
সাঁওতালদের অভ্যন্তরীণ বিচার-আচার তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করে। এছাড়া খাজনা, কর, শুল্ক প্রভৃতি তাঁদের হাতে অর্পণ করা হয়। তাঁরা জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকে। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারি অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না যা এখনও পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link