কুর্দি
কুর্দি (Kurdish, or Kuds) জাতি পশ্চিম এশিয়ার কুর্দিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলের স্থানীয় একটি ইরানি জাতিগোষ্ঠী, যারা দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক, উত্তর-পশ্চিম ইরান, উত্তর ইরাক এবং উত্তর সিরিয়ায় বাস করে। বেশিরভাগ কুর্দিরা ইরান, ইরাক এবং তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় বাস করে।
কুর্দিরা অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা সুফিবাদ এবং অন্যান্য অজানা ধর্মও পালন করে। বিশ্বের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে দীর্ঘদিনের বসবাস এবং দখল থাকা সত্ত্বেও, কুর্দিরা কখনই জাতি-রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি।
বর্তমানে, ‘‘কুর্দিস্তান’’ ইরাক, ইরান এবং তুরস্কের সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকা নিয়ে গঠিত । এই সকল পাহাড়ের গড় উচ্চতা ৬,০০০ ফুট (১৯৫০ মিটার) এবং ভূমির বেশিরভাগ অংশই দুর্গম।
কুর্দি জাতির ইতিহাস
কুর্দিদের প্রাগৈতিহাসিক সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে তাদের পূর্বপুরুষরা সহস্রাব্দ বছর ধরে একই উচ্চভূমি অঞ্চলগুলোতে বসবাস করেছিল বলে মনে করা হয়। মেসোপটেমিয়ার সাম্রাজ্যের নথিতে ‘কুর্দিদের’ সদৃশ নামের সাথে পর্বত উপজাতির উল্লেখ রয়েছে। তবে, কুর্দি নামটি ৭ম শতাব্দীতে কুর্দিদের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার সময় প্রচলন হতে পারে।
কুর্দিরা তাদের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় পারস্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। (বর্তমানে পার্সিয়ান সাম্রাজ্য আধুনিক ইরানে পরিণত হয় এবং অটোমান সাম্রাজ্য আধুনিক তুরস্কে পরিণত হয়), কিন্তু ইরান ও তুরস্ক আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, কুর্দিরা নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি।
যদিও, ১৯২০ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত, একটি স্বাধীন কুর্দিস্তান বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯২৩ সালে, কুর্দিস্তান দুটি দেশের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়, যেটি আজ ইরাক এবং তুরস্ক। তারপর থেকে কুর্দিরা ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্কের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে, তারা একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য সংগ্রাম করছে। কুর্দি গেরিলা যোদ্ধারা স্বাধীন কুর্দিস্তানের অঞ্চল জয়ের জন্য অনেক বছর ধরে লড়াই করে আসছে।
তুরস্কে, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) নামে কুর্দিদের একটি কট্টরপন্থী দল রয়েছে, যারা কুর্দিদের স্বাধীনতার জন্য প্রচারণা চালায়। তবে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অনেকে মনে করেন। কারণ হিসেবে বলা যায়, তারা তাদের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিতে বেসামরিক লোকদের হত্যার পথ পর্যন্ত অবলম্বন করে। এ কারণে অনেক কুর্দি তাদের বিরোধিতা করে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
কুর্দি সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ মৌখিক ঐতিহ্য রয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় হল লজ নামক মহাকাব্য। এসব মহাকাব্যে প্রায়শই প্রেম বা যুদ্ধের সাহসিকতার কথা প্রাধান্য থাকে।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে, কুর্দি সাহিত্য প্রথম আবির্ভূত হয়। ১৫৯৬ সালে, বিটলিসের আমির শরফ খান ফারসি ভাষায় কুর্দিদের একটি ইতিহাস রচনা করেন যাকে শরাফনামা বলা হয়। এর একশ বছর পর, ১৯৬৫ সালে, আহমেদ খানি মেমোজিন নামে একটি মহান জাতীয় মহাকাব্য কুর্দি ভাষায় লিখেছিলেন। কুর্দিরা ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত গাওয়ার সময় বাঁশি, ড্রাম এবং উট-উট (গিটারের মতো) যন্ত্র বাজায়।
কুর্দি ভাষা ও জীবনযাপন
কুর্দি ভাষা পশ্চিম ইরানী ভাষা যা ফার্সি এবং পশতুর সাথে সম্পর্কিত। আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখস্তান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইউরোপের সম্প্রদায়গুলো সহ কুর্দি মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৫ মিলিয়ন থেকে ৩০ মিলিয়নের এসব ভাষায় কথা বলে।
কুর্দিদের জীবনযাত্রা ছিল যাযাবরবৃত্তি। মেসোপটেমিয়ার সমভূমি এবং তুরস্ক ও ইরানের উচ্চভূমি জুড়ে ভেড়া ও ছাগল পালনের জন্য যাতায়াত করে। বেশিরভাগ কুর্দিরা কেবলমাত্র প্রান্তিক কৃষিকাজে জড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পরে, এসব অঞ্চলে জাতীয় সীমানা নির্ধারণের ফলে, ভেড়া ও ছাগল পালের স্থানান্তর বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ফলস্বরুপ, কুর্দিরা তাদের গ্রামীণ জীবন এবং চাষের ঐতিহ্যগত উপায় ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং অপ্রচলিত অন্যন্য কর্মসংস্থানে প্রবেশ করে।
খাদ্য
বুলঘুর (ফাটা গম) কুর্দিদের প্রধান খাদ্য ছিল। বর্তমানে, চাল খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কুর্দিরা বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি খেতে পছন্দ করে, বিশেষ করে শসা। তারা উপত্যকায় আঙ্গুর ফল চাষ করে। মাংস শুধুমাত্র বিশেষ অনুষ্ঠানে খাওয়া হয়। তাদের সাধারণ পানীয় হল চা। কুর্দিরা সকালের নাস্তায় এক ধরনের ওয়েফার রুটি এবং রান্না করা যেকোনো ধরনের শস্য খায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link