অপারেশন সার্চলাইট কি
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ওপর যে সেনা অভিযান চালিয়েছিল, তার সাংকেতিক নাম হল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহ’ত্যা চালিয়ে বাঙালি তথা পূর্ব পাকিস্তানকে নি’শ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী একটি সশ’স্ত্র অভিযান পরিচালনা করেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্র’তিহত করতে এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল। অভিযানের মূল পরিকল্পনায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নির’স্ত্রীকরণ এবং বিরুদ্ধগামী বাঙালি ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের হ’ত্যা করা। এছাড়াও সকল প্রকারের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বি’চ্ছিন্ন করা।
অপারেশন সার্চলাইটের পেছনে যুক্তি ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যর্থ হলে সামরিক অভি’যান চালিয়ে পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
পটভূমি
১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বাঙালিরা আশা করেছিল যে এবার নিশ্চয় ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ৬ দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে। ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধান ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন।
এই স্থগিতকরণের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ ১৯৭১ এ একটি গণসমাবেশের আয়োজন করে। এর আগে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত অর্ধদিবস হরতাল পালনের নির্দেশ প্রদান করেন। ৭ই মার্চের সমাবেশ এতই সফল ছিল যে পাকিস্তান সরকার পূর্বপাকিস্তানের সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়। ফলস্বরুপ, স্বাধিকার আন্দোলন পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, অসহযোগ আন্দোলন, এবং সকল প্রকার প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু ৩৫ টি নির্দেশ প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষিতে, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি পূর্ব পাকিস্তানে একটি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করে।
এই অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল ১৮ই মার্চ। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ঢাকায় ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তখন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। তিনি ছিলেন 'অপারেশন সার্চলাইট' এর অন্যতম পরিকল্পনাকারী। তিনি 'A Streanger in My Own Country East Pakistan 1969-1971' শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে পাঠান।
দুইজন সেখানে যাওয়ার পর, টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে না। যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মিলিটারি অ্যা’কশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। সেই অনুযায়ী ১৮ই মার্চ ক্যান্টনমেন্টে খাদিম হুসাইন রাজার বাসায় রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইটের জন্য একটি খসড়া তৈরি করেন।
খসড়া অনুযায়ী, ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দায়িত্ব নেন রাও ফরমান আলী, আর বাকি সমগ্র প্রদেশে অভিযানের দায়িত্ব নেন খাদিম হুসাইন রাজা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তাঁর 'Witness to surrender' শিরোনামের একটি বইয়ে 'অপারেশন সার্চলাইট' নিয়ে লিখেছেন, জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখা’ত করা এবং পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
অপারেশন সার্চলাইট এর ফলাফল
সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে ২৫ মার্চের পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার খবর সর্বপ্রথম সারা বিশ্বকে জানান। তাঁর মতে,
২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল বিশেষ করে জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বং’স করে দেয়। প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহ’ত হয় এবং সেই সাথে ড. গোবিন্দ দেব, ড. মনিরুজ্জামান ও ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর নিহ’ত হন। অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান লক্ষ্য ছিল হি’ন্দু এলাকাগুলো।
এছাড়াও আরো প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন, যেখানে পাকিস্তান বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়। পিলখানার ইপিআর বাহিনীর ওপরও আক্র’মণ করে, প্রতিরোধ করতে গেলে পুলিশ ও ইপিআরের বহু সৈন্য নি’হত হয়। সেই রাতে ঢাকা সহ একযোগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আক্র’মণ করা হয়। ফলস্বরুপ, ২৫ মার্চ রাতে প্রায় ৫০ হাজারের মত মানুষ প্রা’ণ হারায়।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হ’ত্যা করা হয়, গ্রেফতার হয় প্রায় ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে বেড়ে চলল মৃ’তের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট আর ধ্বং’স তাদের নেশায় পরিণত হলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link