আইন ব্যবস্থা কি?
আইন ব্যবস্থা (Legal System) হল আইনের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের জন্য একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। বিশ্বের তিনটি প্রধান আইন ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন নাগরিক আইন, সাধারণ আইন এবং ধর্মীয় আইন। আইন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে নিয়ম, পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে সরকারী উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বৈধ উপায়ে পরিচালিত হতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের তিনটি প্রধান আইন ব্যবস্থা। যেমন,
১. মহাদেশীয় আইন ব্যবস্থা (সিভিল বা বেসামরিক আইন)
২. অ্যাংলো-আমেরিকান আইন ব্যবস্থা (সাধারণ আইন)
৩. ধর্মীয় আইন ব্যবস্থা
প্রতিটি দেশ তার আইন ব্যবস্থায় বিভিন্নতা বিকাশ করে বা অন্যান্য আরো বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা
বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা একটি লিখিত সংবিধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং আইনগুলো প্রায়শই আইনসভা দ্বারা প্রণীত এবং সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের সংবিধান এবং সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনগুলো ব্যাখ্যা করার ক্ষমতাসহ এবং কোন অসঙ্গতি দেখলে সেগুলোকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। বাংলাদেশের আইনগুলো ইংরেজি সাধারণ আইন ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। আইন ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও, বাংলাদেশের অধিকাংশ আইন সংবিধিবদ্ধ আইন, যা আইনসভায় প্রণয়ন হয় এবং উচ্চতর আদালত ব্যাখ্যা করে।
'আইন' শব্দটি বাংলাদেশ সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ১৫২-এ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে "আইন" অর্থ নিয়ম, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, প্রজ্ঞাপন বা অন্যান্য আইনি উপকরণ এবং কোনো প্রথা বা ব্যবহার। এই সংজ্ঞার অধীনে, সংসদের আইন, অধ্যাদেশ এবং রাষ্ট্রপতির আদেশগুলোকে প্রাথমিক আইন হিসাবে গণ্য এবং নিয়ম ও প্রবিধানগুলোকে গৌণ আইন হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ব্রিটিশ আমলে গভর্নর-জেনারেল ইন কাউন্সিল কর্তৃক রেগুলেটিং অ্যাক্ট, ১৭৭৩-এর মাধ্যমে প্রণীত সাতটি প্রবিধান প্রাথমিক আইন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল এবং যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ কোডে অন্তর্ভুক্ত হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে হয়েছে যে আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের যে কোনো একটি বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন তার অধীনস্থ সকল আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। অতএব, বিধিবদ্ধ আইন, গৌণ আইন এবং রায় আইন সহ প্রথা ও ব্যবহার সবই বাংলাদেশের আইনের উৎস।
বাংলাদেশের অনেক মৌলিক আইন যেমন দণ্ডবিধি, দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, চুক্তি আইন এবং কোম্পানি আইনগুলো ইংরেজি সাধারণ আইন দ্বারা প্রভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত। তবে পারিবারিক আইন যেমন বিবাহ সম্পর্কিত আইন, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং উত্তরাধিকার ধর্মীয় লিপির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
সাধারণত, নির্বাহী কর্তৃপক্ষ এবং সংবিধিবদ্ধ কর্পোরেশন কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। তবে আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত উপ-আইন তৈরি করতে পারে। এই ধরনের অধস্তন আইন বিধি বা প্রবিধান হিসাবে পরিচিত এবং যা আদালত দ্বারা প্রয়োগযোগ্য।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে অধস্তন আদালত থেকে আগত বিভিন্ন আপিলের শুনানি ও পুনর্বিচার মামলা গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে। এ ছাড়া রিট হিসেবে এ বিভাগকে মৌলিক অধিকার কার্যকর করার জন্য আদেশ ও নির্দেশনা জারি করা এবং রিটের আওতায় অন্যান্য ছাড় প্রদানের ক্ষমতাও দেয়া হয়।
আপিল বিভাগের রয়েছে হাইকোর্ট ডিভিশন এবং যেকোন সংবিধির অধীন অন্যন্য সংস্থার সিদ্ধান্তের উপর আপিলের শুনানি গ্রহণ করার ক্ষমতা। হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা।
সুপ্রিম কোর্টকে বলা হয় কোর্ট-অব-রেকর্ড। সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা অথবা অধস্তন আদালতের অবমাননার জন্য যে কাউকে এটি শাস্তি দিতে পারে। আপিল বিভাগে ঘোষিত আইনগুলো হাইকোর্ট বিভাগের জন্য বাধ্যতামূলক এবং উভয় বিভাগের যেকোনটির ঘোষিত আইন সকল অধস্তন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক।
হাইকোর্ট বিভাগ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ যেকোন আইন বাতিল ঘোষণা করতে পারে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে অধস্তন আদালতসমূহের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন আইন ব্যবস্থার কাঠামো বিদ্যামান। যেমন,
- শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
- সরকারি কর্মচারীদের চাকুরি সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল আছে।
- আয়কর সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
- পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোর্ট অব সেটেলমেন্ট।
- ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।
- শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ বিচারের জন্য রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত।
- নির্বাচনী বিরোধসমূহ নিষ্পত্তির জন্য রয়েছে নির্বাচন ট্রাইব্যুনাল।
- পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালত গঠন করা হয়েছে।
- জেলা অথবা অতিরিক্ত জেলা বিচারকদের সভাপতিত্বে গঠিত দেউলিয়া আদালতে ঋণখেলাপি হওয়ায় দেউলিয়া ঘোষণার ব্যবস্থা রয়েছে।
- অনূর্ধ্ব ষোল বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের অপরাধের বিচার করার জন্য দায়রা বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে কিশোর আদালত।
- সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধসমূহের বিচার করার জন্য কোর্ট মার্শাল আদালত।
- ছোটখাটো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির জন্য গ্রামে গ্রামীণ আদালত এবং শহর এলাকায় পৌর সালিশ বোর্ড রয়েছে।
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে কর, শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট সংক্রান্ত মামলাসমূহ নিষ্পত্তি করে।
অধিকন্তু আরও বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের আইন রয়েছে, যা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং পরিমন্ডলে কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কোনো ব্যক্তিকে প্রতিবিধানের জন্য যথাযথ আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করতে হয়। দাবির মূল্য অনুযায়ী অর্থ, সম্পত্তি, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি সম্পর্কিত অভিযোগ দেওয়ানি আদালতে এবং অপরাধের বিরুদ্ধে অভিযোগ ফৌজদারি আদালতে দায়ের করতে হয়।
পক্ষান্তরে, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্যে অভিযোগ গ্রহণ করলে আদালতে সাক্ষীদের উপস্থিত করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর উপর বর্তায়। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেও প্রতিবিধান চাইতে পারে। এ সকল কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ অথবা ট্রাইব্যুনাল। মৌলিক অধিকার কার্যকরকরণ, সামুদ্রিক বাণিজ্য, কোম্পানির বিষয়াদি ও রিট আবেদন ব্যতীত কোনো বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগের নিকট সরাসরি প্রতিবিধান চাওয়া যায় না, কারণ হাইকোর্ট বিভাগ প্রধানত অধস্তন আদালতসমূহের সিদ্ধান্তের ওপর আপিল ও পর্যালোচনার ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
সরকারের মুখ্য আইন কর্মকর্তা হলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি পদাধিকারবলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং আইনজীবীদের নেতা। তাকে তার কাজে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, উপ-অ্যাটর্নি জেনারেলগণ ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলগণ সাহায্য করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রের পক্ষে মামলাসমূহ পরিচালনা করেন। জেলায় দেওয়ানি বিষয়ে সরকারি উকিল হলেন মুখ্য সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং তাকে সহায়তা দান করেন অতিরিক্ত ও সহকারী সরকারি উকিলগণ। তারা অধস্তন দেওয়ানি আদালতে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব এবং রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। একইভাবে ফৌজদারি বিষয়ে জেলায় পাবলিক প্রসিকিউটর হলেন আরেকজন মুখ্য আইন কর্মকর্তা। তাকে সাহায্য করেন সহকারী আইনজীবী। তারা জেলার দায়রা আদালত, দায়রা পর্যায়ের আদালত বা ট্রাইব্যুনালসমূহে রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পুলিশ ইন্সপেক্টর রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link