ডানপন্থী এবং বামপন্থী রাজনীতিতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রয়োগে ভিন্ন দুটি মতাদর্শ যাদের উভয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। বামপন্থী এবং ডানপন্থী মতাদর্শের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ব্যক্তিদের অধিকার বনাম সরকারের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। এছাড়া রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নির্ধারণে বামপন্থা ও ডানপন্থা শব্দের উদ্ভব বলে অনেকে মনে করেন।
চলুন জেনে নেওয়া যাক বামপন্থী এবং ডানপন্থী দলের সংজ্ঞা, উৎপত্তি, বৈশিষ্ট্য এবং উভয়ের পার্থক্য।
বামপন্থী কি?
বামপন্থী রাজনীতি (Left-wing politics) হল প্রচলিত ধর্ম, সমাজ ও গতানুগতিক বিধি বিধানের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা। বামপন্থী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হল সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, অগ্রগতি এবং সংস্কারের উপর জোর দেওয়া।
বামপন্থীদের আদর্শিক ভিত্তি অনুযায়ী ধর্ম এবং রাজনীতি দুইটি আলাদা বিষয়। সুতরাং তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধর্মকে আলাদা রাখে, ধর্মীয় বিষয়কে তারা প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী নয়। সমাজতন্ত্রী ও প্রগতিশীলদেরই এখন সাধারণভাবে বামপন্থী বলা হয়।
ডানপন্থী কি?
ফরাসি বিপ্লবের সময় যারা সংসদের ডানদিকে বসেছিল এবং যারা রাজতান্ত্রিক পুরানো শাসন বা প্রাচীন শাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন করেছিল তাদেরকে ডানপন্থী (Right-wing) বলা হত। এদের প্রাচীন শাসনের আমূল পরিবর্তনের প্রতি বিরোধিতা এবং ঐতিহ্যগত সমাজ রক্ষার আকাঙ্ক্ষা ছিল। ঐতিহ্য, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং অর্থনীতির বেসরকারিকরণ ডানপন্থীদের মূল মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচিত হত।
প্রচলিত সমাজ, ধর্ম এবং নিয়মের অনুকুলে রাজনীতি হচ্ছে 'ডানপন্থী" রাজনীতি। ডানপন্থী রাজনীতি কর্তৃত্ব, শ্রেণিবিন্যাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
এই মতাদর্শের লোকেরা ধর্মীয় নিয়ম ও বিধিবিধানকে আদর্শ হিসাবে ধরে রাজনৈতিক কলাকৌশল পালন করা। ডানপন্থীদের সবকিছুতেই ধর্মের নিয়ম কানুন মুখ্য হয়ে থাকে।
বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনীতির উৎপত্তি
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় বাম (left) শব্দটির উৎপত্তি হয়। তখন, পার্লামেন্টে সভাপতির ডানদিকে বসত শাসকদল যারা অভিজাত শাসনব্যবস্থা, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তথা চার্চ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমর্থন করত। এবং বাঁম পাশের আসনগুলোয় বসত বিরোধীদল যারা বিপ্লব এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেছিল এবং পুরানো শাসনের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করত। বাম দিকের লোকেরা আমূল পরিবর্তন, সমাজতন্ত্র এবং প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ছিল অর্থাৎ রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি শক্তিশালী ফরাসি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে।।
বাঁম দিকে বসার জন্য তাদের বলা হতো বামপন্থী বা লেফটিস্ট এবং ডানদিকে বসা দলকে বলা হত ডাপন্থী। পরবর্তীকালে ফ্রান্সের অনুকরণে অন্যান্য দেশের আইনসভায়ও বিরোধী দলের সদস্যদের বামদিকে বসার রীতি চালু হয়।
১৮১৫ সালে রাজতন্ত্রের পুনর্প্রতিষ্ঠার পরে, উগ্র-রাজতন্ত্রীদের নির্দেশ করতে ডানপন্থী বলা হত। যদিও ফ্রান্সে ঐতিহ্যগত রক্ষণশীলদের নির্দেশ করতে 'ডানপন্থা' ব্যবহৃত হত, পরবর্তীতে, ইংরেজিভাষী দেশগুলোতে এই বিশেষণের অর্থ আরও বিস্তৃত হয়ে উদারপন্থী রক্ষণশীল, ঐতিহ্যগত উদারপন্থী এবং উদারবাদী রক্ষণশীল, এবং পাশাপাশি খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক এবং কিছু জাতীয়তাবাদীদের নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়।
বিশ শতক পর, বামপন্থী হতে হলে যে বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা হচ্ছে বামপন্থিদের সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী হতে হবে।
বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনীতির পার্থক্য
১. ফরাসি বিপ্লবের সময় যারা সংসদের ডানদিকে বসেছিল এবং যারা রাজতান্ত্রিক পুরানো শাসন বা প্রাচীন শাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন করেছিল তাদেরকে ডানপন্থী বলে। অন্যদিকে, ফরাসি বিপ্লবের সময় সংসদে বাঁম পাশের আসনগুলোয় বসত বিরোধীদল যারা বিপ্লব এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেছিল এবং পুরানো শাসনের রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করত, তাদেরকে বামপন্থী বলা হত।
২. বামপন্থী রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গিতে উদার। বিপরীতে ডানপন্থী রাজনীতি বেশি রক্ষণশীল।
৩. বামপন্থী রাজনীতি হল প্রচলিত ধর্ম, সমাজ ও গতানুগতিক বিধি বিধানের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করা। প্রচলিত সমাজ, ধর্ম এবং নিয়মের অনুকুলে রাজনীতি হচ্ছে ডানপন্থী রাজনীতি।
৪. বামপন্থী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হল সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, অগ্রগতি এবং সংস্কারের উপর জোর দেওয়া। অন্যদিকে, ডানপন্থী রাজনীতি কর্তৃত্ব, শ্রেণিবিন্যাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয়তাবাদের ধারণায় জোর দেয়।
৫. বামপন্থী অর্থনীতির নীতিগুলোর মধ্যে আয়ের সমতা হ্রাস করা, ধনীদের জন্য করের হার বৃদ্ধি এবং সামাজিক কর্মসূচি এবং অবকাঠামোতে সরকারী ব্যয় জড়িত। বিপরীতে, ডান এর অর্থনৈতিক নীতিতে কম কর, সরকার দ্বারা ব্যবসার উপর কম নিয়ন্ত্রণ জড়িত।
৬. বামপন্থী জাতীয়তাবাদ সামাজিক সাম্য, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয়-সংকল্পের উপর ভিত্তি করে। এটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বিপরীতে,
ডানপন্থীরা রোমান্টিক জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত যেখানে রাষ্ট্র ভাষা, জাতি এবং কাস্টম সহ এটি পরিচালনা করে।
৭.বামপন্থী রাজনীতি ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবং বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র ও ধর্ম একে অপরের থেকে আলাদা হতে হবে (ধর্মনিরপেক্ষতা)। বিপরীতে, ডানপন্থী রাজনীতি বিশ্বাস করে যে সমাজে ধর্মের একটি প্রসারিত ভূমিকা পালন করা উচিত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link