১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ঘুমন্ত মানুষের উপর নির্বিচা*রে হামলা চালায়। তারা এটির নাম দিয়েছিল ‘‘অপারেশন সার্চ লাইট’’। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধে সবাইকে যাপিয়ে পড়ে এদেশকে হানাদার এবং দখলমুক্ত করতে নির্দেশ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই, সমগ্র বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ১১টি যুদ্ধক্ষেত্র বা সেক্টরে ভাগ করা হয়। এর আগে, জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সার্বিক পর্যালোচনা করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন সেক্টর গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং এই লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে সমন্বয় সভা আয়োজনের জন্য কর্নেল ওসমানীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়।
পরবর্তীতে, ১০ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই, কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হবে, কে কোন সেক্টরের কমান্ডার হবেন, কয়টা ব্রিগেড তৈরি হবে, ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১১ জুলাই ১৯৭১, মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ ও সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল বা সেক্টর গঠনের সম্মন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং সেক্টরগুলোকে আবার সাব সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন একজন সেক্টর কমান্ডার। ১০নং সেক্টরটি ছিল মূলত উপকূলীয় অঞ্চল এবং এর দায়িত্ব সর্বাধিনায়কের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এই সেক্টরের অধীনে ছিলো নৌ কমান্ডো বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর
মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর, এর সীমানা এবং সেক্টর কমান্ডারদের নাম নিম্মে দেওয়া হল।
মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর
চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর মুহুরী নদীর পূর্ব পর্যন্ত সীমনা নিয়ে ১নং সেক্টর গঠিত হয়। ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও ফেনী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সেক্টর। এর সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনাতে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। সেই সাথে ১নং সেক্টরকে আরো পাঁচটি সাব সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই সেক্টরে প্রায় দশ হাজার মুক্তযোদ্ধা যুদ্ধ করেন যাদের মধ্যে ছিল ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং নৌ বাহিনী। এছাড়াও ছিল গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টর
ঢাকা, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও কুমিল্লার অংশবিশেষ নিয়ে ২নং সেক্টর গঠিত। ভারতের ত্রিপুরার রাজ্যের মেলাঘরে ছিল সেক্টর ২ এর সদর দপ্তর। মেজর খালেদ মোশাররফ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এটিএম হায়দার এই সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। এই সেক্টরে ৬টি সাব-সেক্টর ছিল। ২নং সেক্টরের অধীনে প্রায় ৩৫ হাজার নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনী যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৩নং সেক্টর
কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ ছিল ৩ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। হবিগঞ্জ, আখাউড়া–ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্ব দিকে কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষ এবং কিশোরগঞ্জ ও ঢাকার কিছু অংশ নিয়ে ৩ নং সেক্টর গঠিত হয়।
৩নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কলাগাছিয়ায়। মেজর কে এম শফিউল্লাহ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। মেজর এএনএম নুরুজ্জামান সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এসেক্টরের অধীনে ১০টি সাব-সেক্টর ছিল। ইস্ট বেঙ্গল, সিলেট ও ময়মনসিং এর ইপিআর সদস্যদের নিয়ে এই সেক্টর গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৪নং সেক্টর
মৌলভীবাজার ও সিলেটের পূর্বাংশ ৪ নং সেক্টরের অংশ ছিল। মূলত সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ৪ নং সেক্টর। উত্তরে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে দক্ষিণে কানাইঘাট থানা পর্যন্ত বিস্তৃত সীমান্ত এলাকা নিয়ে এটি গঠিত।
মেজর সিআর (চিত্তরঞ্জন) দত্ত এবং পরে ক্যাপ্টেন এ রব ছিলেন এর কমান্ডার। এই সেক্টরের সদর দপ্তর প্রথমে করিমগঞ্জে থাকলেও পরবর্তীতে আসামের মাছিমপুরে স্থানান্তর করা হয়। এই সেক্টরে ৬টি সাব সেক্টর ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টর
বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং সিলেট জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ৫নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল। এর সদর দপ্তর ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের বাঁশতলায়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। এই সেক্টরকেও ৬টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়ছিল। প্রায় ৮ শত নিয়মিত বাহিনী এবং ৫ হাজার গেরিলা বাহিনীর সমন্বয়ে এই সেক্টরটি গঠন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ৬নং সেক্টর
সমগ্র রংপুর এবং দিনাজপুরের ঠাকুরগাও মহকুমা নিয়ে ৬নং সেক্টর গঠিত। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এমকে বাশার। এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল পাটগ্রামের বুড়িমারিতে। এটি একমাত্র সেক্টর যার সদর দপ্তর ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এই সেক্টরে ৫টি সাব-সেক্টর ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টর
রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুরের দক্ষিণ অঞ্চল ও রংপুরের কিছু অংশ নিয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল।
প্রথমে মেজর নাজমুল হক, পরে সুবেদার মেজর এ রব ও মেজর কাজী নুরুজ্জামান এই সেক্টরে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর সদর দপ্তর ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের তরঙ্গপুরে। এই সেক্টরে ৮ টি সাব সেক্টর ছিল। প্রায় ১৫ হাজার নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলার সমন্বয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ৮নং সেক্টর
কুষ্টিয়া, যশোর, দৌলতপুর সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত, খুলনা জেলা ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে ৮নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল। এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল কল্যানীতে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এই সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ মঞ্জুর। এই সেক্টরে ৭টি সাব-সেক্টর ছিল। প্রায় ২৮ হাজার নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী সেক্টরটিতে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৯নং সেক্টর
বরিশাল, পটুয়াখালী, ও খুলনা ও ফরিদপর জেলার কিছু অংশ নিয়ে ৯নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল। এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের বসিরহাটের টাকিতে।
৯নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে প্রথমে মেজর এম এ জলিল দায়িত্বরত ছিলেন। এরপর কিছু সময় মেজর জয়নাল আবেদীন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন মেজর এম এ মঞ্জুর। ৯ নং সেক্টরে ৩টি সাব-সেক্টর ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ১০নং সেক্টর
সকল নৌপথ ও সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে ১০ নং সেক্টর গঠিত হয়। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, নৌ কমান্ডো ও আভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন ১০ নং সেক্টরের অধীনে ছিল।
এই সেক্টরের কোনো সাব-সেক্টর ছিল না এবং কোনো সেক্টর কমান্ডারও ছিলো না। ফ্রান্সে প্রশিক্ষণরত পাকিস্তান নৌবাহিনীর আটজন বাঙালি কর্মকর্তা এই সেক্টর গঠনের উদ্যোক্তা ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টর
বৃহত্তর ময়মনসিং ছিল সেক্টর ১১-এর অন্তর্ভুক্ত। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে ১১ নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল। এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের আসামের মহেন্দ্রগঞ্জ।
মেজর এম আবু তাহের এপ্রিল থেকে ৩ই নভেম্বর পর্যন্ত ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারপর এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ফ্লাইট লেফট্যান্যান্ট এম হামিদুল্লাহ। এই সেক্টরকে ৮টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link