বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি
‘‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’’ এই মূলনীতিকে প্রধান করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি ক্ষুদ্র দেশ, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, আমরা চাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’।
এই উক্তির মধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল তাৎপর্য নিহিত। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য এটাই। নিম্মে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি, বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা হল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের সংবিধানের নিম্নোক্ত বিধানসমূহ থেকে উদ্ভূত যেমন,
১. সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে,
- অন্যান্য রাষ্ট্রের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা।
- অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
- আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করা।
- আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘ সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা, এ সকল নীতিই হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এ সকল নীতির ভিত্তিতে-
ক. রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে।
খ. প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে।
গ. সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণ্যবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে।
২. রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করতে সচেষ্ট হবে।
৩. সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদে যুদ্ধ-ঘোষণা সংক্রান্ত নীতি বর্ণিত রয়েছে। যেমন, সংসদের সম্মতি ব্যতিত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না, কিংবা প্রজাতন্ত্র কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না।
৪. সংবিধানের ১৪৫(ক) অনুচ্ছেদে বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে ‘‘বিদেশের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হবে, এবং রাষ্ট্রপতি তা সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করবেন। তবে শর্ত হচ্ছে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোন চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হবে।’’
৫. জাতিসংঘ সনদের ২(৪) ধারায় বলা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সকল সদস্য-রাষ্ট্র আঞ্চলিক অখন্ডতার বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন থেকে এবং জাতিসংঘের উদ্দেশ্যের সংঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোনো উপায় গ্রহণ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে’।
৬. জাতিসংঘ সনদের ২(৭) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘‘বর্তমান সনদ জাতিসংঘকে কোনো রাষ্ট্রের নিছক অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার দিচ্ছে না বা সেরূপ বিষয়ের নিষ্পত্তির জন্য কোনো সদস্যকে জাতিসংঘের দারস্থ হতে হবে না; কিন্তু সপ্তম অধ্যায় অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে এই নীতি অন্তরায় হবে না।’’
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এবং জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ উপরোক্ত মূলনীতির উপর তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য
সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য নিম্মোক্ত বর্ণনা করা হল।
ক. নিরপেক্ষতা: বাংলাদেশকে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশী সাহায্যের প্রয়োজন হওয়ায় অন্য ব্লকে যোগ দিয়ে কোনো বৃহৎ শক্তির বিরোধিতা করার সামর্থ্য নেই। তাই এর জন্য বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
খ. সার্বভৌমত্বের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা।
গ. অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। নীতিটি জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ২(৭) এর সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ঘ. শান্তির নীতি: শান্তির এই নীতির বেশ কিছু তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ দেশগুলোর মধ্যে বিবাদের প্রশান্ত মীমাংসার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবং তৃতীয়ত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিষয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনকে উৎসাহিত করে।
ঙ. আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করা থেকে বিরত।
চ. সাম্য এবং জাতীয় সুবিধা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উদ্দেশ্য
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্যে সমূহ হল যেমন,
- স্বার্থ সংরক্ষণ (Protection of interests)
- অর্থনৈতিক অগ্রগতি (Economic progress)
- ইতিবাচক নিরপেক্ষতা (Positive Neutrality)
- সুরক্ষার পাশাপাশি জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি (Increase national strength along with protection)
- মতাদর্শ (Ideology)
- জাতীয় মর্যাদা (National dignity)
- শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান (Peaceful Coexistence)
- জোট নিরপেক্ষতা (Non Alignment)
- সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক (Friendly Relations to all)
স্বার্থ সংরক্ষণ
আত্মরক্ষাই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ। একটি রাষ্ট্রের স্ব-সংরক্ষণ বলতে তার সার্বভৌমত্বের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখাকে বোঝায়। এটি জাতীয় নিরাপত্তার সুরক্ষার সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পরবর্তী লক্ষ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু বিশাল সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে ধনী হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় নীতিনির্ধারকদের নিরন্তর প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে।
সুরক্ষার পাশাপাশি জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি:
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো আমাদের জাতীয় শক্তির সুরক্ষা এবং বৃদ্ধি করা। এখানে জাতীয় শক্তি বলতে দেশের মোট শক্তিকে বোঝায়, যা তার পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয় শক্তি হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ খাদ্য এবং শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি। এবং বাংলাদেশের জন্য তার মোট সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা।
মতাদর্শ
প্রতিটি আধুনিক রাষ্ট্রই কোনো না কোনো আদর্শ অনুসরণ করে বা অন্তত সমসাময়িক বিশ্বে প্রচলিত কোনো বড় আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার থাকে। বাংলাদেশ সরাসরি পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ অনুসরণ করে না। এটিই জোট নিরপেক্ষতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
জাতীয় মর্যাদা
বাংলাদেশকে অবশ্যই বিশ্বে তার নিজস্ব মর্যাদা এবং একটি অনুকূল ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে হবে যা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের মাধ্যমেই সম্ভব এবং এভাবে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link