দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

ভূ-রাজনৈতিক হল রাজনীতি, অর্থনীতি বা সামরিক বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে একজন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে ভৌগলিক গুরুত্ব। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান আফগানিস্তানকে উপজাতীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ান এবং চীনা প্রভাব সীমিত করার ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতে পারে।

বিখ্যাত ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক Halford Mackinder-এর ‘Heartland’ তত্ত্ব কিংবা Alfred Mahan-এর ‘Sea Power’ তত্ত্ব ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বকে অনেক বছর ধরে বিশ্লেষণ করেছেন।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো কৌশলগত অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে ভূ-কৌশলগত ও ভূ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেছে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহি শক্তিগুলো তাদের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে যুক্ত করতে চায়।


দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব, azhar bd academy

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের হাওয়া প্রায় দুই দশক আগেই শুরু হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির পরীক্ষার মাধ্যমেই দক্ষিণ এশিয়ার এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও গুরুত্ব শুরু হয়।

ভারত মহাসাগরকে পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের সাথে সেতুবন্ধনে অঞ্চলটি কৌশলগত গুরুত্ব বহন করে। অধিকন্তু, এই অঞ্চলটি সামুদ্রিক বাণিজ্যের একটি অত্যাবশ্যক সংযোগস্থল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের উৎপাদকদের ভোক্তা রাষ্ট্রগুলির সাথে সংযুক্ত করেছে।

১৯৯১ সালে বিশ্ব রাজনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলকে যেভাবে এটি প্রভাবিত করেছিল, দক্ষিণ এশিয়ার বেলায় সেটি ঘটেনি। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পরও দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষীয় বিরোধ ছিল, সেগুলোর তেমন কোনো সমাধান হয়নি। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার  আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টিও খুব একটা গতি লাভ করেনি। 

যাইহোক, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মানচিত্র, ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে সার্বিকভাবে পুরো অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারতের অর্থনীতি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির মধ্যে ভারত তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সেই অর্থনৈতিক শক্তি এই অঞ্চলে অবস্থিত। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিও গত দুই দশকে ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের স্থায়ী ও অস্থায়ী উপাদান

কোনো অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কতগুলো স্থায়ী ও অস্থায়ী উপাদান থাকে। স্থায়ী উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে,


আঞ্চলিক ব্যবস্থা: দক্ষিণ এশিয়ায় যে আঞ্চলিক ব্যবস্থা আছে, তাতে ভারত এখানে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সেইসাথে বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। যে রাষ্ট্রগুলোকে কেন্দ্র করে একটি আঞ্চলিক ব্যবস্থা আছে, তা একটি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। দক্ষিণ এশিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত আছে। এখানে একদিকে ভুটান বা নেপালের মতো Landlocked দেশগুলো যেমন ভারতের প্রতিবেশী, একই সঙ্গে বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কাও ভারতের প্রতিবেশী। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিশাল সমুদ্রসীমা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তিন দিকে সীমান্ত রয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিশাল স্থলসীমা রয়েছে। ফলে ভারতকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে একধরনের ভূ-রাজনৈতিক আন্তনির্ভরশীলতা পরিলক্ষিত হয়।

ভৌগোলিক অবস্থান: দক্ষিণ এশিয়া ভূ-রাজনৈতিকভাবে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির স্থায়ী উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি বিশাল ভৌগোলিক অবস্থান, এবং একটি ভৌগোলিক সীমানা। এই সীমানার একদিকে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া; আরেক দিকে মধ্য এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য। দক্ষিণ এশিয়ার এক দিকে ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে আরব সাগর। দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তটি সামুদ্রিক যোগাযোগ ও স্থলপথে যোগাযোগের জন্য এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে পূর্ব এশিয়া, এর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হলো চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া।

আন্ত:সীমান্ত: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পারস্পরিক স্থল ও জল সীমান্তে অবস্থিত। আফগানিস্তান ব্যতীত সব কটি দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে ভারতের স্থল ও জলসীমান্ত। দক্ষিণ এশিয়া পেরিয়ে ভারতের সীমান্ত রয়েছে চীনের ও মিয়ানমারের সঙ্গে। ভারতের জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, স্থল ও জলসীমান্ত, বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরে ভারতের ব্যাপক উপস্থিতি ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।


বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একাধিক এশীয় অঞ্চলের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে। যেমন: দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অবস্থিত। এছাড়া ভারতের মূল খণ্ড ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সংযোগস্থল হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান। ‘শিলিগুড়ি করিডর’, বা চিকেন নেক বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যকার ১২ মাইলের একটি করিডর যা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর স্থল যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীন-ভারত সম্ভাব্য বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এই চিকেন নেকটি বন্ধ হয়ে গেলে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ফলে ভুটান ও বাংলাদেশের অবস্থান ভূ-রাজনৈতিক বিচারে সীমাহীন গুরুত্ব বহন করে। 

ভারত মহাসাগর: ২১ শতকে ভারত মহাসাগর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সামুদ্রিক কার্যকলাপের ভিত্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারত মহাসাগরের তেল এবং খনিজ সমৃদ্ধ, সরবরাহ এবং চাহিদা উভয় ক্ষেত্রেই এটিকে শক্তির কেন্দ্রভূমি হিসাবে প্রভাবিত করে, তাই ধীরে ধীরে বিশ্ব অর্থনীতির চালক দক্ষিণ এশিয়ার দিকে মোড় নেয়। 

জনসংখ্যা: দক্ষিণ এশিয়া প্রায় ৫.২ মিলিয়ন বর্গ কিমি (২.০ মিলিয়ন বর্গ মাইল) জুড়ে বিস্তৃত, যা এশীয় মহাদেশের ১১.৭১% এবং পৃথিবীর স্থলভাগের ৩.৫% ভূমিভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ১.৮৯১ বিলিয়ন বা বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ, এটি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ও সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল।

 ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের অস্থায়ী উপাদান

ভূ-রাজনীতির অস্থায়ী কিংবা সমকালীন বিষয়সমূহ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের অস্থায়ী কিছু উপাদান রয়েছে যেমন, 


ভারত-চীন দ্বৈরত: ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বৈরত বিষয়টি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে। ভারত-চীন সম্পর্ক প্রায় দুই দশক ধরে তিক্ততার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৪ সালে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্পর্ক বিশেষভাবে অবনতি হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি, চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি- এই দুই দেশের সম্পর্ককে আরো তিক্ত করেছে।

চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ও শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সদস্যরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাজ্য চীনকে কৌশলগত ও মতাদর্শিকভাবে মোকাবিলা করছে। এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার, হংকং পরিস্থিতি, দক্ষিণ চীন বিরোধ ও চীনের বৈশ্বিক প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে। নিঃসন্দেহে ভারতের চীন বিরোধিতার বিষয়টি আরো গতি পাচ্ছে।

আঞ্চলিক বৈরিতা: ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা, রোহিঙ্গা সংকট, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে বৃহৎ শক্তিসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোকে নজিরবিহীনভাবে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) ও ইন্দোপ্যাসিফিক স্টেটেজি (IPS)-এর মাধ্যমে একধরনের চাপ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কিছু সময় আগে থেকেই অনুধাবন করছিল।

চীনের প্রভাব বৃদ্ধি: ভারত ব্যতীত দক্ষিণ এশিয়ার সব রাষ্ট্রের সংঙ্গে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনের BRI কর্মসূচি, দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক বোঝাপড়া একটি বড় ভূমিকা রাখছে। এই দেশগুলোতে সরকার কিংবা রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে স্পষ্টত চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপ্তি ও গভীরতা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি আছে। নেপাল একটি অন্যতম উদাহরণ। চীন ও ভারতের মধ্যকার এই বাফার রাষ্ট্রটি (Buffer State) বর্তমানে ভারতের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত ও কূটনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে, যা অত্যন্ত বিরল।

আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ভুটান রাষ্ট্র সমূহ এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনেকটা বিচলিত। কোনো কোনো বিষয়ে এ দেশগুলো ইতিমধ্যে চীনের মুখাপেক্ষী হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রাপ্তি একটি প্রধান বিষয়। অন্যদিকে নেপাল দৃশ্যত চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করছে, যা দেশটির সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। 



তথ্যসূত্র
  1. ড. দেলোয়ার হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
  2. www.britannica.com/topic/geopolitics
  3. https://bn.wikipedia.org/wiki/দক্ষিণ_এশিয়া
  4. www.quora.com/What-are-the-geopolitical-significance-of-South-Asia

Do not enter any harmful link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Do not enter any harmful link

Post a Comment (0)

নবীনতর পূর্বতন