ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (কংগ্রেস পার্টি), ভারতের একটি ঐতিহাসিক ও প্রাচীন রাজনৈতিক দল, যা ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একটি মধ্যপন্থী সংস্কারক দল ছিল।
১৯২০ এবং ৩০ এর দশকে, গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পার্টি ১৯১৯ সালের গোড়ার দিকে প্রণীত সাংবিধানিক সংস্কারের অনুভূত দুর্বলতা এবং ব্রিটেনের সেগুলি বাস্তবায়নের পদ্ধতির পাশাপাশি বেসামরিক গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, কংগ্রেস পার্টি ঘোষণা করেছিল যে ভারতকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা না দেওয়া পর্যন্ত যুদ্ধকে সমর্থন করবে না।
ভারত ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ভারতের বেশিরভাগ সময় সরকার গঠন করেছিল, কিন্তু ২০ শতকের শেষের দিকে, এর সমর্থন হ্রাস পায়। নিম্মে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি ও ইতিহাস বিস্তারিত বর্ণনা করা হল।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতা লাভ করেছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর, ভারতীয়রা বুঝতে পারে যে রাজনৈতিক সচেতনতা ছাড়া তাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অবসান ঘটিয়ে ভারতে শাসনের দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকার নিজ হাতে তুলে নেয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে ভারতীয় জনগনের একটি আলাদা সংগঠনের প্রয়োজন রয়েছে।
ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পরে ও ব্রিটিশদের নানা সিদ্ধান্তে ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ভারতের জনগণ আন্দোলন শুরু করে। ১৮৭৮ সালে লর্ড লিটনের শাসনামলে “ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট” “লাইসেন্স অ্যাক্ট” প্রভৃতি আইন পাস হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোদ্ধ করা।
এসব আইনের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি নেতৃত্বে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। এছাড়া লর্ড রিপনের শাসনামলে ১৮৮৩ সালে “ইলবার্ট বিল” সহ অন্যন্য আইন ব্রিটিশদের প্রতি ভারতীয় জনগনদের অসন্তোষ ও ঘৃণা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার জন্য জনগণের দাবি পূরণে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিজস্ব একটি সংগঠন তৈরির অনুভব করে।
অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম নামক এক ইংরেজ ICS কর্মকর্তা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৮৮২ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ভারতীয় জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
অক্টোভিয়ান হিউম চিন্তা করেন যে ভারতীয়দের এই নির্যাতন থেকে বাঁচতে হলে একটি রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের প্রয়োজন। তিনি তার পরিকল্পনা সফল করার জন্য তৎকালীন বড়লার্ড ডাফরিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সহযোগিতা চান। ডাফরিন হিউমের পরিকল্পনা সমর্থন দান করেন।
অক্টোভিয়ান হিউম ডাফরিন কে জানায় যে এই সংগঠনটি রাজনৈতিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হবে। যার মূল উদ্দেশ্য থাকবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। এটি প্রাথমিকভাবে পুনাতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু পুনাতে কলেরার প্রাদুর্ভাবের কারণে এটি বোম্বেতে স্থানান্তরিত হয়।
তারপর ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর, সর্বভারতীয় ৭২ জন প্রতিনিধির সমন্বয়ে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) শহরের গোকুল দাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে এক সম্মেলনের মাধ্যমে এই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠারর সময় ৫৪ জন হিন্দু এবং ২ জন মুসলমান এবং বাকিরা জৈন ও পার্সি সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ বাঙালি বুদ্ধিজীবী উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এই সভার সভাপতিত্ব করেন। অধিবেশনের উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট্য ব্যক্তি দাদাভাই নওরোজি, দিনশ ওয়াচা, উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন, ফেরোজশাহ মেহতা প্রমুখ।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে দাদাভাই নওরোজি, ফিরোজ শাহ মেহতা, কে.টি, তেলেঙ্গা, রমেশচন্দ্র দত্ত, বদরুদ্দীন তৈয়বাজি উল্লেখযোগ্য।
১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠালগ্নে বলা হয়েছিল যে, ইংরেজ শাসনের প্রতি অবিচল আনুগত্যই হবে এই প্রতিষ্ঠানের মূলভিত্তি। কংগ্রেস মধ্যপন্থি নেতাগণদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সকল জাতির সমন্বয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অভাব-অভিযোগ দূর করার উদ্দেশ্যে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের দেশের জনমত সংগঠিত করা এবং দেশ শাসন ব্যবস্থায় জনগণের জন্য কিছু অংশীদারিত্ব অর্জনই ছিল এর লক্ষ্য।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ:
- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমস্ত এলাকা সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ভারতীয়দের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন।
- জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সমস্ত বর্ণ বৈষম্য দূর করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা।
- সিভিল সার্ভিস এবং সশস্ত্র বাহিনীতে আরও ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা
- রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে শলা-পরামর্শ করে ভারতীয় জনগণের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা চিহ্নিত ও তা সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো।
- নীতি নির্ধারণ ও রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা।
- বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের নিয়োগ বাড়ানো।
- প্রাদেশিক আইন পরিষদের সম্প্রসারণ ও নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি করা।
- দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ।
- শুল্ক বৈষম্য দূর করে শিল্পের প্রসার ঘটানো।
- লবণ কর হ্রাস, ভারত থেকে কুলি চালান বন্ধ করা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link