পার্লামেন্টে ফ্লোর ক্রসিং (Floor crossing) করার অর্থ হল পক্ষ পরিবর্তন করা। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দল ছেড়ে অন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়াকে ফ্লোর ক্রসিং বলে।
ফ্লোর ক্রসিং প্রধানত দুভাবে হতে পারে।
(১) বিপক্ষ দলে সরাসরি যোগ দিয়ে, অথবা
(২) সংসদে কোন বিলে নিজের দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে।
একজন সংসদ সদস্য (বা কাউন্সিল) অন্য দলে যোগ দিতে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য তার রাজনৈতিক দল ত্যাগ করার মাধ্যমে ফ্লোর ক্রসিং করতে পারেন। উদাহরণস্বরুপ, ব্রিটিশ হাউস অফ কমন্সের সদস্যরা ফ্লোরের বিপরীত দিকে বসা লোকদের একটি দলে (অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের) যোগ দিতে ফ্লোর অতিক্রম করে।
দ্বিতীয়ত, ফ্লোর ক্রসিং শব্দটি একটি নির্দিষ্ট এবং বিশেষ প্রশ্নে হাউস বা সংসদে নিজের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়াকে বোঝায়।
সুতরাং, এই আইনটি মূলত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এমপি, মন্ত্রীদের স্বাধীনতা হরণ করে। নিজের দলের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেও তা করার কোনো উপায় নেই। ফ্লোর ক্রসিং আইনটি ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এখনো ফ্লোর ক্রসিংয়ের ঘটনা ঘটে কেননা তাতে সংসদ সদস্যদের নির্বাচনী আসন হারানোর ঝুকি নেই। টনি ব্লেয়ারের আমলে তার লেবার পার্টির আনা বিলের বিরূদ্ধে ভোট দিয়ে বিলকে আইনে পরিণত হওয়া ঠেকিয়ে দিয়েছিল নিজ দলীয় সংসদ সদস্যরা।
বাংলাদেশের ফ্লোর ক্রসিং আইন
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের প্রণীত সংবিধানে ৭০ নং অনুচ্ছেদে ফ্লোর ক্রসিং আইন অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনটি সংসদে ফ্লোর ক্রসিং প্রতিরোধ করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। এটি ছিল দলত্যাগ বিরোধী বা ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী আইন।
বাংলাদেশের সংবিধানে আর্টিকেল ৭০ এ ফ্লোর ক্রসিংয়ের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধি-নিষেধ রয়েছে। কোন সংসদ সদস্য ফ্লোর ক্রস করলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এতে করে সংসদ সদস্যরা দলীয় লেজুড় বৃত্তিতে বাধ্য হচ্ছেন। আইনপ্রণেতা হিসেবে তাদের সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
এই আইনটি মূলত সংসদীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যকে বাধাগ্রস্ত করে। সংসদীয় সরকারের মূল চেতনা হল সরকার আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু, দলত্যাগ বিরোধী বা ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী আইনের অধীনে, সরকার এবং নির্বাহী বিভাগ এমন একটি অবস্থানে থাকে যেখান থেকে তারা স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থা অনুশীলন করতে পারে, কারণ সরকারের বিপক্ষে প্রতিবাদ বা ভোট দেওয়ার মতো কেউ নেই। সুতরাং, আইনসভায় সরকারের কোন অনৈতিক বিল পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা ভোট দেওয়ার কেউ থাকবে না।
১৯৭২ সালের সংবিধানে ফ্লোর-ক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে প্রধানত দুটি শর্ত ছিল:
১. যদি কোন সদস্য তার দল থেকে পদত্যাগ করেন। এবং
২. ভোটের সময় তিনি যদি তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন।
কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ফ্লোর ক্রসিং বিরোধী আইনকে শক্তিশালী করতে আরও দুটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। তারা হল:
১. যদি কোন সদস্য সংসদে উপস্থিত থাকেন কিন্তু তারপরও ভোটদানে অংশ না নেন।
২. যদি কোন সদস্য ইচ্ছাকৃত সংসদে উপস্থিত না হন।
দ্বাদশ সংশোধনীতে আরও দুটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।
১. কেউ একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি গ্রুপ গঠন করতে পারবেন না।
২. একজন নির্বাচিত সদস্য যদি অন্য কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেন তাহলে তা ৭০ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link