তেভাগা আন্দোলন ছিল মূলত শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিপ্লব। কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষ হলেও বেশিরভাগ কৃষক ছিল ভূমিহীন। যার ফলে, তারা কোনো জমিদার বা জোতদারের অধীনে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত। ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগ ধরে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন ও শোষণের শিকার হয়েছে কৃষক বা বর্গাচাষিরা। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন বা কৃষক আন্দোলনের কারণ ও ফলাফফ এবং গুরুত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা।
তেভাগা আন্দোলনের কারণ
প্রাচীনকাল থেকেই উপমহাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের সমৃদ্ধির পেছনে কৃষকদের অবদান থাকলেও কৃষকদের সমৃদ্ধি কখনোই হয়নি। ভারতবর্ষে কৃষক সম্প্রদায় মূলত নিঃস্ব হতে থাকে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ব্রিটিশদের অধীনে জমিদার, এবং ভূস্বামীগণ লাভবান হলেও কৃষকরা ছিল অবহেলিত।
তাছাড়া অধিকাংশ কৃষক ছিল ভূমিহীন। তারা কোন জমিদার বা ভূস্বামীর জমি বর্গা চাষ করে জীবনযাপন করতো। কিন্তু অন্যের জমি চাষ করে ভূমিহীন কৃষক বা বর্গাচাষীরা উৎপন্ন ফসলের মাত্র অর্ধেক বা আরও অনেক কম পেতো। অথচ ফসল ফলানোর জন্য বীজ থেকে শুরু করে প্রায় সকল প্রকার আর্থিক ও শারীরিক শ্রম দিতে হতো কৃষকদের।
বছরের পর বছর এভাবে মাত্রারিক্ত শোষণ নিপীড়নে এক সময় শোষিত বর্গাচাষীরা আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর -এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে এ- আন্দোলন।
আন্দোলনে ভূমিহীন কৃষকদের দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে জমির মালিক আর দুই ভাগ পাবে কৃষক। তিন ভাগের একভাগ অর্থাৎ তেভাগা থেকেই এই আন্দোলনের নাম হয় তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬ সালে এই আন্দোলন শুরু হয়ে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের সাথে কৃষকসমাজ প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।
মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই মূলত তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তেভাগা আন্দোলনের একজন অগ্রদূতি মহিলা ছিলেন ইলা মিত্র। সাঁওতালদের কাছে যিনি 'রানীমা' নামে পরিচিত। ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি, তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ায় তিনি রোহনপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতার অবস্থায় পুলিশের বর্বর পৈশাচিক নির্যাতনের শিকারও হন ইলা মিত্র।
১৯৪৬-৪৭ সালে দুই বাংলায় মোট ১৯টি জেলায় তেভাগা আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। সকল সাম্প্রদায়িকতা ও বিবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে 'নিখিল ভারত কৃষক সভা'র নেতৃত্ব হিন্দু-মুসলমান সকলে এক ভ্রাতৃত্বের ছায়ায় এসেছিল। যার ফলে দুই বাংলায় তীব্রতা লাভ করে তেভাগা আন্দোলন।
আরো পড়ুন, আলীগড় আন্দোলন - উদ্দেশ্য, প্রভাব ও ফলাফল
তেভাগা আন্দোলন দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, হাওড়া, হুগলী, মালদহ, বাঁকুড়া, নদীয়া, চব্বিশ, পরগণা, মেদিনীপুর ও জলপাইগুড়ি ইত্যাদি জেলায় সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চব্বিশ-পরগনা জেলায় এ আন্দোলনের সর্বাধিক তীব্রতা অনুভূত হয়।
প্রায় ৬০ লক্ষ বর্গাচাষী এ আন্দোলনে অংশ নেয়। দিনাজপুর জেলার তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছিল তেভাগা আন্দোলনের মূল সূতিকাগার। তৎকালীন দিনাজপুরের ৩০টি থানার মধ্যে ২২টি থানাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের প্রভাব। দিনাজপুরে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ।
এই আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী মুহম্মদ দানেশ, ইলা মিত্র, অজিত বোস, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, কাঁসারি হালদার, সুশীল সেন, নূর জালাল, গণেশ দাস, কৃষ্ণবিনোদ রায়, ভূপাল পাণ্ডা, রূপনারায়ণ রায়, ডক্টর গণেন্দ্রনাথ সরকার, কালী সরকার। নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল তেভাগার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও ছিল আদিবাসী হাসদা সম্প্রদায়ের শিবরাম মাঝি।
আন্দোলনের প্রথমদিকে জমিদারশ্রেণী পুলিশ, লাঠিয়াল বাহিনী, মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে দমনের চেষ্টা চালায় কিন্তু তাদেরকে হার মানতে হয় নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য দাবির কাছে। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে তেভাগা আন্দোলন।
পটভূমি
তেভাগা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে। এই আন্দোলনের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটা পরোক্ষ এবং সূক্ষ্ম যোগসূত্র রয়েছে। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর কর্নওয়ালিস কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালুর পর থেকে বাংলার কৃষকেরা একের পর এক জমির মালিকানা হারাতে থাকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। কৃষকেরা জমির মালিকানা হারিয়ে পরিণত হয় ভাড়াটে মজুরে বা বর্গাচাষী।
এদিকে কৃষক ও জমিদারদের মাঝখানে জোতদার নামে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা জমিদারদের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে কৃষকদের মাধ্যমে চাষ করাতো এবং খাজনা আদায় করত।
১৯৩৬ সালে সোচ্চার কৃষকদের নিয়ে গঠিত হয় 'নিখিল ভারত কৃষক সভা'। তাদের নীতি ছিল, 'লাঙল যার জমি তার'। বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করে 'ফ্লাউড কমিশন'। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের জমির মালিকানা প্রদান এবং উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দু'ভাগ মালিকানা চাষীদের প্রদান করতে সুপারিশ করে -এ কমিশন। ১৯৪৬ সালে বাংলার প্রাদেশিক কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সূচনা হয় তাদের ন্যায্য হিসাব বুঝে নেওয়ার আন্দোলন এই তেভাগা আন্দোলন।
তেভাগা আন্দোলনের ফলাফল
তেভাগা আন্দোলন বিংশ শতাব্দিতে উপমহাদেশের দরিদ্র কৃষক এবং উপজাতীয় বর্গাচাষীদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশকে প্রতিফলিত করেছিল। এই আন্দোলনের ফলাফল বা প্রভাব ছিল সূদুর প্রসারি। নিম্মে তেভাগা আন্দোলনের ফলাফল, গুরুত্ব এবং প্রভাবসমূহ বর্ণনা করা হল।
১. তেভাগা আন্দোলন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গে এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, কৃষকেরা সেসব অঞ্চলকে তেভাগা এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে। এবং স্থানীয়ভাবে এলাকার শাসনের জন্য তেভাগা কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
২. ১৯৪৭ সালে ২২ জানুয়ারি, সরকার আন্দোলনের চাপে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিধানসভায় ‘বঙ্গীয় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল’-১৯৪৭ উত্থাপন করে।
৩. দীর্ঘ ৪৬ বছরের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এড়িয়ে এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান সমানভাবে অংশগ্রহণ করে।
৪. জমির মালিকরা তেভাগা আন্দোরনের কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের সাথে চুক্তি করে।
৫. জমিদার বা ভূস্বামীগণ প্রায় ৪০ ভাগ বর্গাচাষীকে স্বেচ্ছায় তেভাগা দেয়।
৬. খাজনার নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধ বা সীমিত করা হয়।
৭. ১৯৫০ সালের ‘জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০’ বিলের মধ্য দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটে।
৮. বিনয় চৌধুরীর নেতৃত্বে, ২.৪ মিলিয়ন উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
আরো পড়ুন, নীল বিদ্রোহ কি? নীল বিদ্রোহের কারণ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link