তেজস্ক্রিয়তা কি?
তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা (Radioactivity) বলে। তেজস্ক্রিয়তার একক হলো বেকরেল (Bq)। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ।
তেজস্ক্রিয়তা হলো ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির বিকিরন। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত নিউক্লীয় ও স্বাভাবিক ঘটনা।পর্যায় সারণির যেসব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮২-এর বেশি সেগুলো মূলত তেজস্ক্রিয় পদার্থ। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত মৌল সমূহের মধ্যে তেজস্ক্রিয় মৌল মোট ১৪ টি।
১৮৯৬ সালে, ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরী বেকরেল এক্সরে নিয়ে গবেষনা করার সময় একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক ঘটনা আবিষ্কার করেন। তিনি দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম ধাতুর নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত বিশেষ ভেদন শক্তি সম্পন্ন রশ্মি নির্গত হয়। তাঁর নামানুসারে এই রশ্মির নাম দেওয়া হয় বেকরেল রশ্মি।
পরবর্তীকালে, মাদাম কুরি ও পিয়েরে কুরি আরো বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে দেখতে পান যে রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, থোরিয়াম, আ্যক্টিনিয়াম প্রভৃতি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস থেকেও বেকরেল রশ্মির মত একই ধরনের রশ্মি নির্গত হয়, যা বর্তমানে তেজষ্ক্রিয় রশ্মি নামে পরিচিত।
তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রকারভেদ
তেজস্ক্রিয় পদার্থ হতে সাধারণত ৩ ধরনের কণা বা রশ্মি নির্গত হয় যেমন—আলফা রশ্মি , বিটা রশ্মি, এবং গামা রশ্মি। তবে, অনেক ক্ষেত্রে পজিট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনো কণা ইত্যাদিও নির্গত হতে পারে।
১. আলফা রশ্মি
আলফা কণা হলো কিছু তেজস্ক্রিয় পদার্থ দ্বারা নির্গত হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। এটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত কণা যার আধান 3.2 x 10-19 কুলম্ব। এটির ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর ভরের চার গুণ অর্থাৎ 6.694 x 10-27 kg। ভর বেশি হওয়ায় এর ভেদন ক্ষমতা কম। এটি একটি চার্জযুক্ত কণা তাই বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে এর গতিপথকে প্রভাবিত করা যায়।
২. বিটা রশ্মি
এটি ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণা যার আধান 1.6 x 10-19 কুলম্ব। এর ভর ইলেকট্রনের সমান অর্থাৎ 9.1 x 10-31 kg। এটি চৌম্বক ও তড়িক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়। এটিও প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে। বিটা কণার প্রতীক β।
৩. গামা রশ্মি
এটি নিরপেক্ষ আধানবিশিষ্ট রশ্মি এবং তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ। এর কোনো ভর নেই। গামা কণা বৈদ্যুতিক এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্র দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। এর বেগ আলোর বেগের সমান অর্থাৎ (3x10*8 m/s)। গামা রশ্মির প্রতীক γ।
তেজস্ক্রিয়তার বৈশিষ্ট্য
- তেজষ্ক্রিয় পদার্থ সাধারনত আলফা, বিটা ও গামা এই তিন ধরনের তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করতে পারে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে পজিট্রন, নিউট্রন, নিউট্রিনো ইত্যাদি কণাও নির্গত হতে পারে।
- তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ৮৩-এর বেশি হয়।
- তেজষ্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয় ঘটনা। এর নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আরেকটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
- তেজষ্ক্রিয়তাকে তাপ, চাপ, বিদ্যুৎ বা চৌম্বক ক্ষেত্রের ন্যায় বাইরের কোন সাধারণ ভৌত প্রক্রিয়া দ্বারা এর সক্রিয়তাকে রোধ বা হ্রাস বৃদ্ধি করা যায় না।
- তেজস্ক্রিয়তা হল নিউক্লিয়াসের ভাঙ্গন।
- তেজস্ক্রিয় ভাঙ্গনের সময় নিউক্লিয়াস থেকে আলফা এবং বিটা কণা কখনও একসঙ্গে নির্গত হয় না।
তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার
- বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার হয়। এটি ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত কার্যকর।
- প্যাকেজিং খোলা ছাড়া খাদ্য সামগ্রি জীবাণুমুক্ত করতে এটি ব্যবহৃত হয়। এটি খাবারকে দীর্ঘস্থায়ী করে এবং খাদ্যজনিত সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
- প্রাচীন প্রত্নবস্তুর বয়স নির্ধারণ। কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে জীবাশ্মসংক্রান্ত নমুনা ও শিলাখন্ডের বয়স নির্ধারণ করা হয়।
- আলফা কণা স্মোক ডিটেক্টরে ব্যবহৃত হয়।
- গামা বিকিরণ চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
- উন্নত বীজ তৈরির গবেষণায় তেজষ্ক্রিয়তা সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- খনিজ পদার্থে বিভিন্ন ধাতুর পরিমাণ নির্ণয়ে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
- ঘড়ির কাঁটায় তেজষ্ক্রিয় থোরিয়ামের সাথে জিঙ্ক সালফাইডের প্রলেপ দেওয়ার ফলে এটি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে।
- তেজস্ক্রীয় আইসোটোপ থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- কাগজ, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি বিভিন্ন বস্তুর পুরুত্ব, ঘনত্ব ও উপাদানের সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ে আলফা ও বিটা রশ্মিকে ব্যবহার করা হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link