আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ মূলত ইউরোপীয় শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। তবে, এটি আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতাদের দ্বারা নতুন জাতি গঠনের পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, ইউরোপীয় শক্তিগুলো কার্যত সমগ্র আফ্রিকা দখল করে। ফলে, আফ্রিকান দেশগুলো নিজেদের সার্বভৌমত্ব হারায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব শুরু হয়। মিশরে সাদ পাশা জাঘুল এবং ঘানায় কোয়ামে নক্রুমা- আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী ধারণা শুরু করেছিলেন। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ আত্ম-নিয়ন্ত্রণের (নিজ দেশ শাসন করা) দাবির উপর ভিত্তি করে এবং আফ্রিকার অ-উপনিবেশকরণ প্রক্রিয়াকে বাধ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ঔপনিবেশিক শাসনের পরিবর্তনের সাথে এবং আফ্রিকাতে সামাজিক পরিবর্তনের ফলে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ একটি গণ আন্দোলন হিসাবে আবির্ভূত হয়। ১৯৫০ এর দশকে, আফ্রিকার প্রায় সকল উপনিবেশে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিা লাভ করে। নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থানের ফলে ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে আফ্রিকার অ-উপনিবেশকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখেছিল। তখন, জাতীয়তাবাদী নেতারা ঔপনিবেশিক ইউরোপীয় প্রভাব অনুসরণ করে তাদের নিজস্ব সামাজিক এবং জাতীয় পরিচয় খুঁজে পেতে সংগ্রাম করতে থাকে।
প্রাথমিকভাবে, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগ্রাম মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। তারা নিজেদেরকে ঔপনিবেশিক কর্মকর্তা এবং আফ্রিকান জনগণের মধ্যে দালাল হিসেবে দেখত। কিন্তু স্থানীয় সাধারণ জনগণ আফ্রিকাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল। তারা ইউরোপীয় মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে।
এডওয়ার্ড উইলমট ব্লাইডেন অনুভব করেছিলেন যে আফ্রিকানদের অবশ্যই তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। কারণ, উপনিবেশিক শাসনের পুরো সময়কালে, আফ্রিকানদের বলা হয়েছিল যে, তাদের সংস্কৃতিগুলো অসভ্য, আদিম, মন্দ এবং বর্বর এবং তাদের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি বড় অগ্রগতি প্যান-আফ্রিকানবাদী আন্দোলনের সাথে এসেছিল। যা আফ্রিকানদের একত্রিত করতে এবং সমস্ত আফ্রিকানদের মধ্যে মিল এবং সংযোগের উপর জোর দিয়ে জাতিগত বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিল। প্যান-আফ্রিকানবাদের দুজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন মার্কাস গার্ভে এবং ডব্লিউইবি ডুবোইস।
গ্রেট ডিপ্রেশন (১৯২৯-৩৯) আফ্রিকাকে ব্যাপকভাবে আঘাত করেছিল। দারিদ্রতা সর্বত্রই গ্রাস করেছিল। কর্মসংস্থানের অভাবে, অনেকে গ্রামাঞ্চল থেকে শহুরে এলাকায় স্থানান্তরিত হয় এবং ফলে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এসব মোকাবেলায় কোন প্রদক্ষেপ নেয়নি কারণ তাদের সম্পদ এবং মনোযোগ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। ১৯৪০-এর দশকে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরও উগ্র হয়ে উঠছিল, এবং আফ্রিকানরা সর্বত্র ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল।
১৯৩৫ সালে ইথিওপিয়ায় ইতালীয় আগ্রাসন আফ্রিকার ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ইথিওপিয়া ছিল আফ্রিকার একমাত্র সত্যিকারের স্বাধীন দেশ। আক্রমণটি আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরো উগ্রপন্থী করে তোলে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ পূর্ণরুপে বিকাশ লাভ করে। ১৯৫০-এর দশকের মধ্যে, প্যান-আফ্রিকানবাদ প্রায় প্রতিটি আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন কোয়ামে এনক্রুমাহ, কেনিয়াটা, নয়েরে, কেনেথ কাউন্ডা, হেইলে সেলাসি, আলবার্ট লুথুলি ইত্যাদি সবাই গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং জাতীয়তাবাদের প্রচারে আফ্রিকান নারীদের অবদান ছিল অনেক। অনেকে যুক্তি দেখান যে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নারীরা সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছিল। কেনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের সরকার মহিলাদের চলাচল সীমিত করে এবং এমনকি তাদের শহরাঞ্চলে নিষিদ্ধ করেছিল।
মহিলারা ঔপনিবেশিক শাসনের কঠোর পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিক্ষোভ, বয়কট, এবং ধর্মঘট আয়োজন করেছিল। কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, আলজেরিয়া এবং অন্যান্য এলাকায় নারীরা সশস্ত্র সংগ্রামের চেষ্টা করেছিল। সামগ্রিকভাবে, আফ্রিকা জুড়ে ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর তাদের প্রভাব ছিল গভীর।
উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতীয়তাবাদ
প্রতিটি আফ্রিকান জাতি স্বাধীনতার একটি অনন্য পথ বেছে নিয়েছিল। আলজেরিয়া, মোজাম্বিক এবং জিম্বাবুয়ে, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালানোর মতো চরম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। বেশিরভাগ দেশ অহিংস উপায় অনুসরণ করে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর অর্জন করে।
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর, আফ্রিকান দেশগুলো বামপন্থী মতাদর্শের (যেমন মার্কসবাদ এবং সমাজতন্ত্র) বা পুঁজিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। Nyerere, Nkrumah, Ahmed Sékou Touré, এবং Muammar Gadhafi বামপন্থী মতবাদকে "স্বদেশীকরণ" করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা আফ্রিকার দুর্ভাগ্যের জন্য পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল যে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উৎখাতই আফ্রিকাকে সত্যিকারের মুক্ত করার একমাত্র উপায়।
কিন্তু বামপন্থী দেশ, যেমন কিউবা, ইউএসএসআর এবং চীন, যথেষ্ট সাহায্য ও সমর্থন প্রদানে অক্ষম প্রমাণিত হওয়ায়, সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদ উভয়ই পরিত্যক্ত হয়। যে দেশগুলো পুঁজিবাদকে বেছে নিয়েছিল তারাও সমানভাবে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। কারণ আফ্রিকার অর্থনীতি পুঁজিবাদ বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় ছিল না।
১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আদর্শগুলো ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। আফ্রিকান দেশগুলো আঞ্চলিক, জাতিগত বা ধর্মীয় স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে রাজি হয়নি। ফলে, জাতিগত বিভাজন আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদ এবং উন্নয়ন উভয়কেই আঘাত করে। নাইজেরিয়া, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা এবং জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলো জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, গৃহযুদ্ধ এবং গণহত্যায় লিপ্ত ছিল।
অনেক আফ্রিকান দেশ জাতীয়তাবাদের দৃঢ় অনুভূতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল। জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রোগ, বেকারত্ব, বিশ্বায়ন, দুর্নীতি, লোভ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবই স্বাধীনতা-পরবর্তী আফ্রিকার ভয়াবহ বাস্তবতায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয়ে গেলে, আফ্রিকান দেশগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান, একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং অত্যাচারী স্বৈরাচারী আদর্শ হয়ে উঠে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link