জাতীয়তাবাদ হল একটি মানসিক অনুভূতি যা একটি জনসমষ্টিকে অন্য জনসমষ্টি থেকে আলাদা রাখে এবং একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করার অনুপ্রেরণা যােগায়।
যেসব স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলা ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী (ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভৌগােলিক সূত্রে) ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং নিজেদেরকে অন্য জাতি থেকে আলাদা মনে করে, তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বলে। এই আর্টিকেলে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি, উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি গণচেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। সুতারাং ভাষা আন্দোলনই হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি। মূলত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সুসংহত হয় ও অগ্রগতি লাভ করে। এই আন্দোলনের চেতনাই জনগণের মধ্যে পরবর্তীকালে ৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
বাঙালি জনগণের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্খাকে হাজারগুণে বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন। তাই ৫২’র ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গণচেতনার সর্ব প্রথম বহি:প্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
পটভূমি
প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের অপশাসন অবসান হওয়ার পর, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। ভৌগলিক দূরত্বের পরও, শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আদর্শগত কোনো যোগসূত্র ছিল না বললেই চলে। কারণ হিসেবে বলা যায়, উভয় অঞ্চলের মধ্যকার ভাষাগত বিরোধ। ভাষাগত বিরোধের কারণে বাংলার জনগণ পাকিস্তানের আদর্শের সাথে কখনও একাত্মতা অনুভব করতে সক্ষম হয় নি। এছাড়া পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি নানাভাবে বৈষম্যমূলক নীতি আরোপ করা হয় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে।
মূলত এসব কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং ১৯৪৭ সালের সেপ্টেন্বর মাসে পূর্ব বাংলায় ‘তমুদ্দুন মজলিস’ নামে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
এছাড়া ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যোগায় ভাষা আন্দোলন। সুতারাং বলা যায়, ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি ও চেতনা এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল অনুপ্রেরণা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব
আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ যার মূলমন্ত্র হচ্ছে এক জাতি, এক রাষ্ট্র। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই নিয়ন্ত্রণাধিকার রয়েছে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের বুকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। বাঙালিদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। ভাষা, সংস্কৃতি, দৈহিক গঠন ও ভৌগলিক প্রভৃতি কারণে বাঙালি জাতি অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক । আর এ স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রয়াস থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে। এছাড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের উল্লেখযোগ্য কারণ নিম্মে বর্ণনা করা হয়েছে।
১. সাংস্কৃতিক চেতনা
প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙালি জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। কালক্রমে বঙ্গে বসবাসরত নানা জাতি উপজাতির সম্মিলিত মানবস্রোত বাঙালি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এতসব বিচিত্র বর্ণ, আকৃতি বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে যে, বাঙালিদের আদর্শ নৃ-তাত্ত্বিক গঠন প্রকৃতির বর্ণনা দুঃসাধ্য। বলা যায়, গায়ের শ্যামলা রং, মাথার কালাে চুল, মধ্যম আকৃতি, মুখের ভাষা, আচার-আচরণ ও সর্বজনীনতা বাঙালিদেরকে অন্যসব জাতি থেকে আলাদা করে রেখেছে।
২. ভাষাগত চেতনা
ভাষা চেতনার অনিবার্য ফলস্বরূপ পাকিস্তানের মাটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটেছিল। ১৯৫২ সালে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণ ভাষার প্রশ্নে স্বতন্ত্রবােধের পরিচয় দিয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বার স্বতন্ত্র বিকাশের গতিপথ নির্ধারিত হয়েছিল।
৩. ছয় দফা কর্মসূচি
১৯৬৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছয় দফা দাবি উত্থাপিত হয়। ৬ দফা আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে এ দেশের জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রাম। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারংবার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উনসত্তর ও সত্তরের গণআন্দোলন পরিচালনা করেন এবং গণমানুষের চিত্তে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে তুঙ্গে নিয়ে যান। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মনে, চিন্তা-চেতনায় ভাষা আন্দোলন ও ছয় দফা আন্দোলন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, যা থেকে ক্রমান্বয়ে অঙ্কুরিত হয়ে ওঠেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয়তার চেতনা ।
সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মননে মুক্তির আকাক্সক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অঙ্কুরিত হয় বহু আগে থেকেই। শুধু দরকার ছিল একটি সুনির্দিষ্ট প্লাটফরমের। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অবশেষে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এর পিছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে কতগুলাে পর্যায়ের মাধ্যমে। নিচে এসব পর্ব আলোচনা করা হলাে-
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীর উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট হচ্ছিল। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা তখন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। মূলত ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামীলীগসহ বিরােধী দলসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শােচনীয়ভাবে পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পরাজয়ের মাধ্যমে মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে আস্থা হারাতে থাকে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্যপদ লাভ করে। এতে তারা তাদের ঐক্যের গুরুত্ব এবং শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
ছয় দফা আন্দোলন
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানাের ক্ষেত্রে ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচি প্রদানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আহ্বান জানান। এ কর্মসূচি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারাতে সর্বপ্রথম অর্থনৈতিক উপাদানের সংযােজন ঘটিয়ে প্রগতিশীল সমাজবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত করে।
আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা
ছয় দফা দাবির কারণে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী শেখ মুজিবসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। আর এ মামলার মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণতার স্বীকৃতি আসে। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চেতনাবোধ আরাে সুদৃঢ় হয়।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুথান
১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণ তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তােলে। ১১ দফার দাবিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছাড়াও ছাত্র-কৃষক, শ্রমিকের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই সব শ্রেণির মানুষ এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটলে এ অঞ্চলের জনগণ আত্নশক্তিতে অধিকতর বলীয়ান হয়ে ওঠে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান স্বাধিকার আন্দোলনের সাক্ষ্য হিসেবে এদেশের ইতিহাসকে অলংকৃত করেছে।
১৯৭০-এর নির্বাচন
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশে ১৯৭০-এর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় প্রমাণ করে যে, পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানের শাসন হতে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চায়। তাছাড়া এ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী জনগণের জাতীয় সংহতি আরাে সুদৃঢ় হয়।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম
বাংলার জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের জন্য ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাস্তব রূপ লাভ করে। স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘােষণা করা হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link