বায়ুমণ্ডল মূলত গ্যাসের একটি আস্তরণ যা পৃথিবীকে ঘিরে থাকে। পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে এটি পৃথিবী পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করে। বায়ুমণ্ডলের তিনটি প্রধান উপাদান যেমন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং আর্গন। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল প্রধানত ৫টি স্তরে বিন্যস্ত থাকে যা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই আর্টিকেলে, আমরা বায়ুমন্ডল কি, এর প্রধান উপাদান সমূহ এবং বায়ুমন্ডলের স্তরসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বায়ুমণ্ডল কি?
বায়ুমণ্ডল(atmosphere) হল পৃথিবীর চারপাশে ঘিরে থাকা বিভিন্ন গ্যাস মিশ্রিত আস্তরণ, যা পৃথিবী তার মধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা ধরে রাখে। সহজভাবে বলতে গেলে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উর্ধ্ব দিকে যে বায়বীয় আস্তরণ পৃথিবীকে ঘিরে থাকে, তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। এটি নানা প্রকার গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা গঠিত।
এটি সূর্য থেকে আগত অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীতে জীবের অস্তিত্ব রক্ষা করে। জীবজগতের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই বায়ুমণ্ডল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর আকর্ষণে আকৃষ্ট হয়ে এ বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সঙ্গে আবর্তিত হচ্ছে।
বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৯৭ শতাংশই ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাধারণত উপরের স্তরের বায়ু নিচের বায়ুস্তরে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। বায়ুর এই চাপের জন্যই পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে যত উপরে উঠা যায়, বায়ুর ঘনত্ব ততই কমতে থাকে। তবে সমুদ্রপৃষ্ঠে এই বায়ুচাপের ঘনত্ব সব থেকে বেশি দেখা যায়।
বায়ুমণ্ডলের উপাদান
বায়ুমণ্ডল প্রধানত বিভিন্ন ধরনের গ্যাস, জলীয় বাষ্প এবং ধূলিকণা, এই তিন প্রকার উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রায় ৭৮% নাইট্রোজেন, ২১% অক্সিজেন এবং ১% অন্যান্য গ্যাস দ্বারা গঠিত। এই গ্যাসগুলি বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে পাওয়া যায়।
বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে জলীয় বাস্প যার শতকরা ৯০ ভাগ ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬ কিমি. উচ্চতার মধ্যে অবস্থান করে। বায়ুমণ্ডলের মোট ভরের মাত্র শতকরা ০.২৫ ভাগ জলীয় বাষ্প। জলীয় বাষ্পের জন্যই পৃথিবীতে মেঘ, বৃষ্টি, তুষারপাত, কুয়াশা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বায়ুমণ্ডলের তৃতীয় উপাদান হচ্ছে ধূলিকণা যা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কলকারখানার পোড়া কয়লার ছাই, অগ্নুৎপাত ও দাবানলের ছাই, উল্কাপাতের ছাই, ধুলোবালি, লবণকণা প্রভৃতি সুক্ষ্ম ধূলিকণারূপে বায়ুমণ্ডলে ভেসে থাকে।
বায়ুমণ্ডলের স্তর
বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে উষ্ণতার পার্থক্য অনুসারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে পর্যায়ক্রমে বায়ুমণ্ডলকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়। স্তরসমূহ হল ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার, থার্মোস্ফিয়ার, এবং এক্সোস্ফিয়ার।
১. ট্রপোস্ফিয়ার বা ট্রপোমন্ডল:
বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে নিচের স্তরের নাম ট্রপোস্ফিয়ার। এই স্তরটি ভূপৃষ্ঠের সঙ্গে লেগে আছে। মেঘ, বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত, বায়ুপ্রবাহ, ঝড়, তুষারপাত, শিশির, কুয়াশা সবকিছুই এই স্তরে সৃষ্টি হয়। ট্রপোস্ফিয়ারের শেষ প্রান্তের অংশের নাম ট্রপোপজ (Tropopause)। এই স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রায় ১৬-১৯ কিলোমিটার এবং মেরু অঞ্চলে প্রায় ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।
বৈশিষ্ট্য
- ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর ঘনত্ব কমতে থাকে।
- প্রতি ১,০০০ মিটার উচ্চতায় ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস পায়।
- উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায়।
- নিচের দিকের বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে।
- ধূলিকণার অবস্থানের ফলে সমগ্র বায়ুমন্ডলের ওজনের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ এই স্তর বহন করে।
- ট্রপোস্ফিয়ার এবং স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যবর্তী স্থানান্তর অঞ্চল সহ এখানে বেশিরভাগ বিমান চলাচল হয়।
২. স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা স্ট্রাটোমন্ডল:
ট্রপোপজের (Tropopause) উপরের দিকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত স্ট্রাটোস্ফিয়ার নামে পরিচিত। ওজোন স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যে অবস্থিত। এই স্তরের ওজোন অণুগুলি সূর্য থেকে উচ্চ-শক্তির অতিবেগুনী (UV) আলো শোষণ করে এবং এটিকে তাপে রূপান্তর করে।
বৈশিষ্ট্য
- এই স্তরেই ওজোন (O3) গ্যাসের স্তর বেশি পরিমাণে থাকে। ওজোন স্তর সূর্যের আলোর বেশিরভাগ অতিবেগুনি রশ্মি (Ultraviolet Rays) শুষে নেয়।
- এই স্তরের বায়ুতে কোনোরকম জলীয়বাস্প থাকে না। ফলে আবহাওয়া থাকে শান্ত ও শুস্ক। ঝড়, বৃষ্টি না থাকাই, এই স্তরের মধ্য দিয়ে সাধারণত জেট বিমানগুলো চলাচল করে।
৩. মেসোস্ফিয়ার বা মেসোমন্ডল:
স্ট্রাটোবিরতির উপরে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে মেসোস্ফিয়ার বলে।মেসোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে উপরে উঠার সাথে সাথে তাপমাত্রা আরও শীতল হয় যা -90 ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছতে পারে।
বৈশিষ্ট্য
- এই স্তরে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা কমতে থাকে যা -৮৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নিচে নেমে যায়।
- মেসোমন্ডল বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে শীতলতম তাপমাত্রা ধারণ করে।
- মহাকাশ থেকে যেসব উল্কা পৃথিবীর দিকে ছুঁটে আসে সেগুলোর অধিকাংশই এই স্তরের মধ্যে এসে পুড়ে যায়।
- শব্দযুক্ত রকেট এবং রকেট চালিত বিমান মেসোস্ফিয়ারে পৌঁছাতে পারে।
৪. থার্মোস্ফিয়ার বা তাপমন্ডল:
মেসোবিরতির উপরে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে থার্মোস্ফিয়ার বলে। এই স্তরে বায়ু অত্যন্ত হালকা ও চাপ ক্ষীণ। এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 80 থেকে 700 কিলোমিটার উপরে অবস্থিত, যার সর্বনিম্ন অংশে আয়নোস্ফিয়ার রয়েছে।
এই স্তরটি সূর্যের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় তাপমাত্রা 2,000 °C (3,600 °F) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
বৈশিষ্ট্য
- এই স্তরে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪৮০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পৌঁছায়।
- সূর্যের আলোকিত অতিবেগুনী এবং এক্স-রে বিকিরণ শোষণের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
- তীব্র সৌর বিকিরণে রঞ্জন রশ্মি ও অতিবেগুনি রশ্মির সংঘাতে এই অংশের বায়ু আয়নযুক্ত হয়।
- ভূপৃষ্ঠ থেকে পাঠানো বিভিন্ন বেতারতরঙ্গ আয়নমন্ডলের বিভিন্ন আয়নে বাধা পেয়ে পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে।
- কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট থার্মোস্ফিয়ারের মধ্যে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
- অরোরা, নর্দার্ন লাইটস এবং সাউদার্ন লাইটস থার্মোস্ফিয়ারে ঘটে।
- ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS) থার্মোস্ফিয়ার স্তরে প্রদক্ষিণ করে।
৫. এক্সোস্ফিয়ার বা এক্সোমন্ডল:
এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০ থেকে ১০,০০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। এই স্তরে হিলিয়াম ও হাইড্রোজেন গ্যাসের প্রাধান্য দেখা যায়। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তর।
বৈশিষ্ট্য
- এক্সোস্ফিয়ার স্তরের তাপমাত্রা প্রায় ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ১৬৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়।
- এ স্তরে খুব সামান্য পরিমাণ গ্যাস যেমন- অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, অর্গন এবং হিলিয়াম ধারণ করে, কেননা মাধ্যাকর্ষণের ঘাটতির কারণে গ্যাস অণু বা কণাগুলো সহজে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
- এক্সোস্ফিয়ারে আবহাওয়া না থাকলেও, অরোরা বোরিয়ালিস এবং অরোরা অস্ট্রালিস কখনও কখনও এর সর্বনিম্ন অংশে দেখা যায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link