উপসর্গ বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি করতে এবং ভাষার বৈচিত্র প্রকাশে উপসর্গের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। উপসর্গের মাধ্যমে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়, বিপরীত শব্দ তৈরি হয়, শব্দের সম্প্রসারণ ঘটে। এছাড়াও শব্দের অর্থের পরিবর্তন এবং সংকোচন হয়।
উপসর্গ কাকে বলে?
বাংলা ভাষায় এমন কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ আছে, যাদের নিজস্ব কোন অর্থ নেই, কিন্তু অন্য শব্দের শুরুতে বসে নতুন শব্দ তৈরি করতে পারে। ভাষায় ব্যবহৃত এসব অব্যয়সূচক শব্দাংশের নাম উপসর্গ।
সহজভাবে বলতে গেলে, যেসব অব্যয়সূচক শব্দাংশ নামবাচক বা কৃদন্ত শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে, সেসকল অব্যয়সূচক শব্দাংশকে উপসর্গ বলা হয়।
একই উপসর্গ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে, যেমন অ, সু, প্র, প্রতি ইত্যাদি। ‘কাজ’ শব্দের আগে, ‘অ’ অব্যয়টি যুক্ত করলে হয় ‘অকাজ’ এবং ‘সু’ যুক্ত করলে হয় ‘সুকাজ’। তেমনি ‘ক্রিয়া’ শব্দের আগে ‘প্র’ উপসর্গটি যুক্ত করলে হয় ‘প্রক্রিয়া’ এবং ‘প্রতি’ লাগালে হয় ‘প্রতিক্রিয়া’।
উপসর্গের মাধ্যমে শব্দের কয়েক ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন—নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি হয়, শব্দের অর্থের পূর্ণতা সাধিত হয়, শব্দের অর্থের সম্প্রসারণ ঘটে, শব্দের অর্থের সংকোচন ঘটে এবং শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে।
উপসর্গের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বলেছেন,
“সংস্কৃতে কতগুলো অব্যয় শব্দ আছে, এগুলো ধাতুর পূর্বে বসে এবং ধাতুর মূল ক্রিয়ার গতি নির্দেশ করে এর অর্থের সপ্রসারণ, সঙ্কোচন বা অন্য পরিবর্তন আনয়ন করে দেয়। এরূপ অব্যয় শব্দকে উপসর্গ বলে।”
ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের মতে,
“যেসব অব্যয় শব্দ কৃদান্ত বা নামপদের পূর্বে বসে শব্দগুলোর অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ বা অন্য কোন পরিবর্তন সাধন করে, ঐ সব অব্যয় শব্দকে বাংলা ভাষায় উপসর্গ বলে।”
উপসর্গ কত প্রকার
বাংলা ভাষায় উপসর্গকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয় যথা – ১. সংস্কৃত বা তৎসম উপসর্গ ২. খাঁটি বাংলা উপসর্গ ৩. বিদেশি উপসর্গ
১.সংস্কৃত বা তৎসম উপসর্গ:
যেসব উপসর্গ সংস্কৃত বা তৎসম ভাষা থেকে এসেছে, সেসকল উপসর্গকে সংস্কৃত বা তৎসম উপসর্গ বলে। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত উপসর্গের সংখ্যা সর্বমোট ২০টি।
যেমন: প্র, পরা, অপ, সম, নি, অব , সম, নির, দূর, অনু, উৎ, সু, বি, উপ, অধি, পরি, আ, অপি, অভি, অতি, প্রতি।
সংস্কৃত বা তৎসম উপসর্গের ব্যবহার
পরা — পরাজয়, পরাধীন, পরাক্রান্ত।
নি — নিষ্কুলুষ, নিষ্কাম।
প্র — প্রগাঢ়, প্রচার, প্রবল, প্রসার।
অপ — অপমান, অপচয়, অপবাদ।
২. খাঁটি বাংলা উপসর্গ:
বাংলায় আর্যদের আগমনের পূর্বে যেসব জাতিগোষ্ঠী বসবাস করত, তাদের ভাষা থেকে যেসব উপসর্গ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে সেইসব উপসর্গকে দেশি বা খাঁটি বাংলা উপসর্গ বলা হয়। বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা উপসর্গের সংখ্যা সর্বমোট ২১টি।
যেমন: অ, অঘা, অজ, অনা, বি, নি, আ, আড়, আন, আব, ইতি, উন, কদ, কু, পাতি, ভর, রাম,স সা, সু, হা।
খাঁটি বাংলা উপসর্গের ব্যবহার
অ — অকাজ, অমিল, অপয়া।
অনা — অনাচার, অনাবৃষ্টি, অনাদায়
অঘা — অঘারাম, অঘাচণ্ডী ইত্যাদি।
আড় — আড়চোখ।
রাম — রামছাগল, রামদা।
নি — নিখুঁত, নিখোঁজ।
সু — সুফল, সুনজর।
৩. বিদেশি উপসর্গ:
বিদেশিদের আগমনের ফলে বিদেশি ভাষা থেকে যেসব উপসর্গগুলি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলিকে বিদেশি উপসর্গ বলা হয়। বাংলা ভাষায় বিদেশি উপসর্গের সংখ্যা এখনোও নির্ধারিত হয়নি।
বিদেশী উপসর্গ ও এর ব্যবহার
আরবি উপসর্গ: আম , খাস, লা, গর। উদাহরণ- আমদরবার, খাসমহল, লাজওয়াব, গরমিল ইত্যাদি।
ফারসি উপসর্গ: কার, দর, না, নিম ,ফি,বধ, বে, বর, কম। উদাহরণ – কারখানা, দরখাস্ত, নালায়েক, নিমবাজি, বেশরম ইত্যাদি।
ইংরেজি উপসর্গ: ফুল, হাফ, হেড, সাব। উদাহরণ- ফুলহাতা, হাফহাতা, হেডমাস্টার, সাব ইন্সপেক্টর।
উর্দু-হিন্দু উপসর্গ: হর।
উপসর্গের বৈশিষ্ট্য
- উপসর্গের কোন নিজস্ব অর্থ নেই।
- উপসর্গের মূল কাজ নতুন শব্দ সৃষ্টি করা।
- উপসর্গগুলি এক প্রকারের অব্যয় সূচক শব্দাংশ।
- উপসর্গগুলি নামবাচক বা কৃদন্ত শব্দের শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়।
- অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থের বিশিষ্টতা দান করে।
- উপসর্গের মাধ্যমে শব্দের সম্প্রসারণ বা সংকোচন ঘটে।
- উপসর্গগুলো বিপরীত শব্দ তৈরি করে।
উপসর্গের প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষায় উপসর্গের প্রয়োজনীয় অপরিসীম। উপসর্গের সাহার্যে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়, বিপরীত শব্দ তৈরি হয়, শব্দের সম্প্রসারণ ঘটে, অর্থের পরিবর্তন এবং সংকোচন হয়। ভাষার বৈচিত্রতা দানে উপসর্গের ভূমিকা অনেক। বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি করতে উপসর্গ এর ব্যবহার প্রয়োজন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Do not enter any harmful link